ছবি : সংগৃহীত
রবিউল হক
লোকসংস্কৃতির নানা উপাদানে স্বীয় ভাস্বর এদেশের সর্ব-উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। লোকসংস্কৃতি বলতে সাধারণত গ্রামীণ সংস্কৃতিকেই বুঝানো হয়ে থাকে। ব্রিটিশ লোকবিজ্ঞানী উইলিয়াম থমসন ১৮৪৬ সালে লোকসংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক লোকজ উপাদান বোঝাতেই ফোকলোর শব্দটির ব্যবহার করেন। লোকজ উপাদানের মধ্যে এ জেলার লোকসাহিত্য, লোকশিল্প, লোকপোশাক, লোকস্থাপত্য, লোকসংগীত, লোকবাদ্যযন্ত্র, লোকউৎসব, লোকমেলা, লোকাচার, লোকখাদ্য, লোকনাট্য, লোকক্রীড়া, লোকচিকিৎসা, ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন, লোকবিশ্বাস, লোকপ্রযুক্তি, লোকজ যনবাহন, লোকভাষা প্রভৃতি অমূল্য ধারা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর।
পঞ্চগড় জেলার লোকসংগীতের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এই অঞ্চলের লোকসংগীতে প্রতিফলিত হয়েছে গ্রামীণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। এ জেলার প্রচলিত লোকসংগীতের মধ্যে হুলির গান, হেরোয়া (মেয়েলী বা বিয়ের গীত), ভাওয়াইয়া, তিস্তা বুড়ির গান, বৃষ্টির গান, কান্দনী বিষহরির গান, হুদমা দেও এর গান, যুগীর গান, মানিক পীরের গান, সোনা পীরের গান, মাগনের গান, সত্যপীরের গান, বাবালোকনাথের গান, রাখালিয়া গান, কোয়াল গান, চোর-চুন্নির গান, চটকা গান, গাজীর গান, জারি গান, ছাদ পেটানোর গান বা কর্মসংগীত, মারফতি গান, মুর্শিদি গান, মাহফিলের গান বা ভাব-বিচ্ছেদ গান বেশ জনপ্রিয়। তবে এই অঞ্চলের লোকগানে প্রাচীন গোপীচন্দ্র ও মানিক পীরের গান, বৌদ্ধ সহজিয়া এবং মধ্যযুগের বৈষ্ণব মতের গভীর প্রভাব রয়েছে। ভাওয়াইয়া গান রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার প্রধান লোকসংগীত হিসেবে বেশ সমাদৃত। আর এর আদি উৎপত্তিস্থল হিমালয়ের পাদদেশীয় তরাই অঞ্চলে।
আরো পড়ুন : পঞ্চগড় জেলার লোকধাঁধা ও লোকপ্রবাদ
লোকনাট্য পঞ্চগড় জেলার লোকসংস্কৃতিতে অন্যতম জায়গা দখল করে রয়েছে। লোকনাট্যের বিষয়বস্তু হিসেবে বর্তমানে সমাজের নানা অসঙ্গতি ফুটিয়ে তোলা হয়ে থাকে। উন্মুক্ত স্থানে পরিবেশিত এসব লোকনাট্যের মধ্যে জনপ্রিয় হচ্ছে ধামের গান, হুলির গান, বিষহরা গান, সইত্য পীরের গান, মফিজুল ফাতেরার গান প্রভৃতি লোকনাটক আজো তার আবেদন ধরে রেখেছে। এ জেলার লোকনাট্যের মধ্যে হুলির গান নামে যে জনপ্রিয় লোকনাট্য ও লোকগান প্রচলিত রয়েছে তা মূলত ধর্মীয় বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত।দেশের অন্যান্য এলাকার লোকনাটকের ন্যায় এ অঞ্চলের লোকনাটক সংগীতকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। এছাড়া এ অঞ্চলের লোকনাটকে ভাঁড় বা জোকার চরিত্র লোকনাট্যের এক অন্যতম আকর্ষণ। যার সাহসিকতা, বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি দর্শকমনে বিশেষ আনন্দের সঞ্চার করতে সক্ষম। এ অঞ্চলের লোকনাটকের জন্য গোল বা চারকোনা মঞ্চ তৈরি করা হয় এবং তার ওপর ছনের, খড়ের বা কাপড়ের ছাউনি থাকতে পারে আবার নাও পারে। মঞ্চের মাঝখানে কিছুটা অংশ ফাঁকা রেখে অভিনয় শিল্পীরা চতুর্দিকে দর্শক রেখে মাঝখানে গোল করে বসেন। নাট্যগীতি পরিবেশনের সময় তারা একতারা, দোতারা, বাঁশি, করতাল, মাঝারি আকারের ঢোল সংগত হিসেবে ব্যবহার করেন। বর্তমানে কীবোর্ড, প্যাড এসব পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র লোকনাট্যের সাথে কিছুক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পঞ্চগড় জেলার লোকনাটক দেশের অন্যান্য জেলার মতোই হাট-বাজারের এক কোণে, স্কুলের মাঠ বা বড় কোনও গাছতলায় কিংবা মন্দিরের মাঠে আয়োজন করা হয়ে থাকে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে শহরেও বিভিন্ন লোকনাটকের পরিবেশনা লক্ষ করা যায়। মূলত লোকনাটক হচ্ছে লোকসমাজনির্ভর এক ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যম।
সূত্র
১. শামসুজ্জামান খান, বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা: পঞ্চগড়, বাংলা একাডেমি, ২০১৩
২. নাজমুল হক, উত্তরবঙ্গের লোকসাহিত্যের নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক সমীক্ষা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৭
৩. মুহম্মদ আবদুল জলিল, বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ইতিবৃত্ত, অনার্য, ঢাকা, ২০১১
রবিউল হক, লোক গবেষক ও শিল্পী
এস/ আই.কে.জে/