রবিউল হক
মাদার পীরের গান এদেশের মুসলমানদের লৌকিক পীরবাদের আখ্যানধর্মী জনপ্রিয় এক পরিবেশনা। মাদার পীরের আখ্যানধর্মী নাট্য পরিবেশনা বছরের বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। “অগ্নি-নির্বাপণকারী পীর হিসেবে মাদার পীরকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে”।
পরিবেশনার সময়: লৌকিক পীরের আখ্যান কোনও না কোনওভাবে মানত উপলক্ষে বিশেষ করে শীতকালে বেশি আয়োজন করতে দেখা যায়। মাদার পীরের আখ্যানধর্মী পরিবেশনা রাতে কিংবা দিনে যে কোনও সময় অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
আসরের অবস্থান: মাদার পীরের গান পরিবেশনার জন্য বাড়ির ভিতরে বা বাইরে ১০, ১২ অথবা ১৪ ফুটের বর্গাকার ভূমি সমতল মঞ্চ তৈরি করা হয়। চার কোণে চারটি কলাগাছ পুঁতে বা খুঁটি গেরে উপরে ছামিয়ানা টানানো হয়ে থাকে। মেঝেতে বসার জন্য বিছানার চাদর, মাদুর বা চটের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। মঞ্চের মাঝে বৃত্ত করে শিল্পীদের অবস্থান ও চতুর্দিকে দর্শকগণ খড়ের মধ্যে বা চটি বিছানো আসরে বসে মাদার পীরের গান উপভোগ করে থাকেন।
আলোর ব্যবস্থা: মাদার পীরের গান পরিবেশনের জন্য পূর্বে হ্যারিকেন বা হ্যাজাক বাতির ব্যবহার থাকলেও বর্তমানে জেনারেটর বা বিদ্যুতের ব্যবহার বেশ লক্ষ করা যায়।
সাজঘর বা ম্যাকাপ রুম: মাদার পীরের গান পরিবেশনের জন্য সাজঘর হিসেবে আয়োজক বাড়ির কোনও একটি ঘর ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। মুখে হালকা জিংক-অক্সাইড ব্যবহার, সরিষার তেল কিংবা নারিকেল তেল, পানি, কাজল, জরির ব্যবহার, স্নো-পাউডার ব্যবহার, আর নৃত্য শিল্পীদের নাক-কান-গলায় বিচিত্র্য অলংকারের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।
পোশাকের ব্যবহার: মাদার পীরের গানে মূলত লাল বা খয়েরি রঙের কাপড়ের বেশি প্রধান্য। তবে এ গান পরিবেশনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পোশাকের মধ্যে- “বিশেষ ধরনের ধূতি, ওড়না, খিলকা, ধূতি পাজামা, রঙ্গিন ব্লাউজ, একই রঙের কাপড়, প্লাস্টিকের তৈরি মুকুট, আলখেল্লা, শাড়ি (সুতি বা জর্জেটের) ইত্যাদি পোশাকের ব্যবহার হয়ে থাকে।
বাদ্যযন্ত্র: মাদার পীরের গানে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার এক বিশেষ আবহ তৈরি করে। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে করতাল, জুরি, খোল, ঝাঝ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
পরিবেশনা রীতি: ঐতিহ্যবাহী এ নাট্যধারার পরিবেশনায় বর্ণনাত্মক ও সংলাপাত্মক অভিনয়ের মিশ্র প্রয়োগে মূল গায়েন মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। কনসার্টের মধ্যদিয়ে এ গানের পরিবেশনা শুরু হয়ে থাকে। সালাম জানিয়ে সাধারণত করতাল ও খোলের তালে তালে বন্দনা করা হয়। যেমন-
“এক অক্ষর দুই অক্ষর যে জানে কালাম,
তিনার চরণে আমার হাজার সালাম।
এক অক্ষর দুই অক্ষর যে শিখালো মোরে
ভক্তিভাবে তাহার চরণ আমার মস্তকের উপরে।
আমি অধম দশের কদম, বাবা সগোল কিছু নাহি জানি
কেবল ভরসা আমার দশের আঙা চরণখানি।
দীক্ষা গুরু বন্দে গাবো শিক্ষা গুরুর পা
গানের গুরু বন্দে গাবো স্বরসতি মা।
দেশ মাতা জ্ঞান দাতা শিক্ষারও প্রধান
তোমার সাধনা করছে মাগো হিন্দু-মুসলমান”।
তবে এ ধরনের বন্দনা গীতের ক্ষেত্রে প্রতি ছয় কিংবা আট চরণ পরে সমন্বিত বাদ্যযন্ত্রের সাথে ধুয়া অংশ পরিবেশন করা হয়ে থাকে। মাদার পীরের আখ্যান পরিবেশনায় মূল গায়েনকে গীত-সংলাপাত্মক পদ্য ও গদ্যের ব্যবহার করতে দেখা গেলেও মূল গায়েন মাদার এবং শেরশাহ বাদশার চরিত্রে সংলাপাত্মক অভিনয় করে থাকেন।
মাদার পীরের গানের অভিনয় শিল্পীদের বর্তমান অবস্থা: এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাদার পীরের গানের প্রচলন থাকলেও রাজশাহী ও নাটোর জেলায় এ গানের প্রচলন বেশি। নাটোর অঞ্চলে এ গানের প্রসিদ্ধ গায়কের বসবাসের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও মাদার পীরের বেশ কিছু দল রয়েছে এবং তাদের পরিবেশনাতেও বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়।
তথ্যকণিকা
১. সেলিম আল দীন, মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৮, পৃ. ২৮৬
২. সাইমন জাকারিয়া, বাংলাদেশের লোকনাটক: বিষয় ও আঙ্গিক বৈচিত্র্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ৩৮৫-৩৯০
৩. ইসরাফিল শাহীন (সম্পা.), পরিবেশন শিল্পকলা, খন্ড ১২, এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৭।
৪. মাযহারুল ইসলাম তরু, চাঁপাইনবাবগঞ্জের লোকসংস্কৃতির পরিচিতি, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৯।
রবিউল হক, লোক গবেষক ও শিল্পী
আই.কে.জে/