সরস্বতী বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী। সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে পূজা একটি অন্যতম প্রধান হিন্দু ধর্মীয় উৎসব। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা আয়োজিত হয়। তিথিটি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত।মাঘ মাসের শুল্কা পক্ষের পঞ্চমী তিথি বা দিনটি বসন্ত পঞ্চমী তিথি। এই বসন্ত তিথিতেই বাগদেবী সরস্বতী পূজা হয়। মাঘ মাসের শুক্ল পঞ্চমী তিথি আর বসন্তের আগমন। এই দুই মিলে এর অন্য আরেক নাম বসন্ত পঞ্চমী। বাংলাদেশ, ভারত, নেপালসহ বিশ্বের যেসব স্থানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বসবাস করেন সেখানেই সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
পুরান মতে, শুক্লপক্ষের পঞ্চমীর দিনে ব্রহ্মার মুখ থেকে সরস্বতী দেবীর আবির্ভাব ঘটে। ঋকবেদে সরস্বতী একজন দেবীরূপে বর্ণিত আছে। সেই প্রাচীন বৈদিক যুগ থেকে সরস্বতী হিন্দুর অন্যতম দেবী হিসেবে পূজিত হন। সরস্বতী দেবী কোথাও দ্বিভুজা, কোথাও চতুর্ভূজা এই দুই হাতেই পূজিত হন। দুই হাতে বীণা, পুস্তক থাকে। চতুর্ভুজের চার হাতে কলম বীণা পুস্তক ও অক্ষরমালা থাকে। শাস্ত্রীয় প্রথা আচারবিধি মেনে হিন্দু শিক্ষার্থীরা এই পূজা করেন।
বৈদিক দেবী হলেও প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকরা সরস্বতী দেবী বাগেশ্বরী আরাধনাও করতেন। সে সময়কার সরস্বতী পূজা বর্তমান সরস্বতী পূজার মতো ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকি কাঠের উপর তালপাতা, দোয়াত-কলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। কেননা বিদ্যার সমস্ত সরঞ্জাম যেমন বই-খাতা, কালির দোয়াত, খাগের কলম, তালপাতা যার উপরে প্রাচীনকালে লেখা হতো, সবকছুকে দেবী সরস্বতী হিসেবে মানা হতো। সেই কারণে প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে এমনভাবে সরস্বতী পূজার প্রচলন ছিল। তার সঙ্গে ইংরেজি ভাষা সরস্বতী পূজার দিন কোনভাবেই পূজার ক্ষেত্রে রাখা হতো না। অর্থাৎ ইংরেজি বইয়ের পূজা নিষিদ্ধ ছিল। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয়।
দেবী সরস্বতীর সমস্ত রকম সৌন্দর্য ও দীপ্তির উৎস হলো ব্রহ্মা। পূজার দিন দেবী সরস্বতীর মূর্তি শ্বেতবস্ত্র অর্থাৎ সাদা রঙের কাপড় পরিধান করে থাকে, যা পবিত্রতার নিদর্শন হিসেবে মান্যতা করা হয়। দেবী সরস্বতী রূপে-গুণে সবদিক থেকে অদ্বিতীয়া। বিদ্যা, বুদ্ধি ও জ্ঞান সবকিছুতে তিনি সত্ত্বগুণময়ী। তাছাড়া বাকশক্তির প্রতীক হিসেবে বাগদেবী নামে পরিচিত। সংগীত শিল্প এবং বিদ্যার দেবী হিসেবে তাঁর এক হাতে পুস্তক অথবা বই আর এক হাতে বীণা। রাজহাঁসের পিঠে বসে আছেন। রাজহংস হলো জলে, স্থলে এবং অন্তরীক্ষে অর্থাৎ সব জায়গাতেই সমান গতি। তেমনি জ্ঞান ও দক্ষতার গতি সব জায়গাতেই সমানভাবে প্রকাশ পায়। তাছাড়া রাজহাঁস একমাত্র জল ও দুধের পার্থক্য করতে পারে। অর্থাৎ দুধে জল মিশিয়ে দিলে তার মধ্যে দুধ ও জলকে আলাদা করে দিতে পারে। আর সেই কারণেই জ্ঞান সাধনার ভালো-মন্দ পৃথক করতে পারে।
বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মহাসমারোহে সরস্বতী পূজা পালিত হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা এই পূজা আয়োজন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ঢাকার সরস্বতী পূজার প্রধান কেন্দ্র ও আকর্ষণের স্থান হয়ে উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এখানে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। জগন্নাথ হলের সরস্বতী পূজার ব্যাপকতা ও বহুমাত্রিকতা প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পূজাকে কেন্দ্র করে কেবল শিক্ষার্থীরাই নয়, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব পেশার আবাল বৃদ্ধ বনিতার মিলনমেলায় পরিণত হয়।
আই.কে.জে/