ছবি: সংগৃহীত
সৌদি আরবের উত্তর-পশ্চিমের একটি শহরে দ্বিতল ভবনের জানালার কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছেন কালো আবায়া পরা এক তরুণী। পরবর্তী ছবিতে দেখা যায়, একদল পুরুষ তাকে ক্রেনের সাহায্যে নিচে নামিয়ে আনছেন। ওই তরুণীর পরিচয় জানা যায়নি।
ধারণা করা হচ্ছে, তিনি ‘অবাধ্যতা’, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক অথবা পরিবারের অনুমতি ছাড়াই বাড়ি ছাড়ার কারণে ‘দার আল-রায়া’ নামক নারীদের জন্য নির্জন এক আটক কেন্দ্রে বন্দী ছিলেন। এ কেন্দ্রগুলোতে পরিবারের কিংবা স্বামীর রোষে পড়ে নির্বাসিত নারীদের ‘সংশোধনের’ জন্য রাখা হয়। খবর দ্য গার্ডিয়ানের।
এটি ছিল বিরল এক দৃশ্য—যেখানে জনসমক্ষে ধরা পড়ল সেই শত শত সৌদি তরুণী ও নারীদের বাস্তবতা, যাদের ওই সব সংশোধনাগারে আটকে রাখা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানকে বাহ্যিকভাবে ‘আশ্রয়কেন্দ্র’ বা সংশোধনাগার বলা হলেও বাস্তবে সেগুলোকে বন্দিশিবির বা ‘নরক’ বলে অভিহিত করেছেন অনেকে। সেখানে রয়েছে বাধ্যতামূলক ধর্মীয় শিক্ষা, নির্জনতা, বাইরে যোগাযোগের নেই অনুমতি, এমনকি প্রতি সপ্তাহে একবার করে মারা হয় চাবুক।
সেখানকার অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চেষ্টা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বছরের পর বছর ধরে নারীরা সেখানে আটক থাকেন। বের হতে পারেন না পরিবার বা পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া। লন্ডনে অবস্থানরত সৌদি মানবাধিকারকর্মী মরিয়ম আলদোসারি বলেন, ‘একজন তরুণী ততক্ষণ সেখানে থাকবে, যতক্ষণ না সে সমাজের প্রচলিত নিয়ম মেনে নিতে রাজি হয়।’
সৌদি আরব এখন যখন পুরুষদের ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পেয়ে বিশ্বমঞ্চে নিজেদের ‘সংস্কারপ্রবণ’ দেশ হিসেবে তুলে ধরছে। ঠিক এর বিপরীতে, দেশটির নারীরা যারা একটু অধিক অধিকার ও স্বাধীনতার দাবি তুলছেন, তাদের ভাগ্য জুটেছে গৃহবন্দিত্ব, কারাবাস কিংবা নির্বাসন।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এ ‘সংশোধনাগার’ বা দার আল-রায়া মূলত নারীদের নিয়ন্ত্রণ ও শাস্তি দেওয়ার এক গোপন কারাগার।
ষাটের দশকে দেশজুড়ে গড়ে ওঠা এসব ‘সংশোধনাগার’ সম্পর্কে সৌদি কর্মকর্তারা বলছেন, এটি ‘বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত বা দণ্ডিত’ নারীদের আশ্রয়স্থল। সেখানে মানসিক চিকিৎসক ও পরামর্শদাতাদের সহায়তায় নারীদের পরিবারে ফিরিয়ে নেওয়ার উপযোগী করে তোলা হয়।
এ ব্যবস্থাকে চরম নির্যাতনমূলক বলে অভিহিত করেছেন সারা আল-ইয়াহিয়া। তিনি এসব সংশোধনাগার বিলুপ্ত করার আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সারা বলেন, এসব কেন্দ্রে পৌঁছেই নারীদের দেহতল্লাশির পাশাপাশি কুমারীত্ব পরীক্ষা করা হয়। ঘুমানোর আগে দেওয়া হয় ঘুমের ওষুধ।
তিনি বলেন, ‘তারা এটিকে সেবাকেন্দ্র বা সংশোধনাগার বললেও এটা একপ্রকার জেলখানা। সেখানে মেয়েরা নাম ধরে নয়, নম্বর ধরে পরিচিত। যেমন নম্বর ৩৫, সামনে এসো। কেউ যদি নিজের পারিবারিক নাম বলে, তাহলে তাকে চাবুক মারা হয়। নামাজ না পড়লেও চাবুক মারা হয়। আর যদি কোনো নারীর সঙ্গে একা দেখা যায়, তাহলে বলা হয় সে সমকামী। তারপর শুরু হয় নির্যাতন। প্রহরীরা মজা করে দাঁড়িয়ে দেখেন নারীদের চাবুক মারা।’
৩৮ বছর বয়সী ইয়াহিয়া বর্তমানে নির্বাসনে আছেন। তিনি বলেন, মাত্র ১৩ বছর বয়স থেকেই তার বাবা তাকে দার আল-রায়ার ভয়ে ভীত করে তুলেছিলেন। সারা বলেন, ‘যদি আমি তার যৌন নির্যাতন মেনে না নিতাম, তাহলে তিনি বলতেন—তোমাকে ওইখানে (দার আল-রায়া) পাঠিয়ে দেব।’
তিনি আরও জানান, এসব কেন্দ্রের ভয়ে অনেকে নির্যাতনের শিকার হলেও ঘর ছাড়তে ভয় পান। সারা বলেন, আমি একজন নারীকে চিনি, যিনি পারিবারিক সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা একজন নারীকে সাহায্য করেছিলেন। এ অপরাধে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কারণ, সৌদি আরবে কাউকে আশ্রয় দেওয়া—‘যদি সে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়’, তাহলে সেটি অপরাধ।
আরও ভীতিকর তথ্য জানিয়ে ইয়াহিয়া বলেন, ‘যদি কেউ পরিবারের সদস্য দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় বা গর্ভবতী হয়, তাহলে পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য তাকেই দার আল-রায়ায় পাঠানো হয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সৌদি মানবাধিকারকর্মী বলেন, ‘এ নারীদের পাশে কেউ নেই। কোনো অপরাধ না করেও তারা বছরের পর বছর ধরে আটক থাকেন। এ জায়গা থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায়—পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি, বিয়ে কিংবা আত্মহত্যার চেষ্টা।’
আরেক নির্বাসিত মানবাধিকারকর্মী ফাওজিয়া আল-ওতাইবি বলেন, ‘এ সংশোধনাগারগুলো নিয়ে কেউ কথা বলে না, কেউ টুইট করে না। কেউ জানতেও চায় না—আপনি কোথায় গেলেন। তারা ভিকটিমদেরই লজ্জা দেয়।’
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, সৌদি সরকার যদি সত্যিই নারীদের অধিকার রক্ষা করতে চায়, তাহলে এ ধরনের সংশোধন কেন্দ্রগুলো বিলুপ্ত করে প্রকৃত নিরাপদ সংশোধনাগার গড়ে তুলতে হবে।
সৌদি মানবাধিকার সংস্থা এএলকিউএসটি বলছে, দার আল-রায়া হলো এমন এক ধরনের প্রতিষ্ঠান, যা সৌদি সরকারের নারীবান্ধব ভাবমূর্তির সঙ্গে একেবারে সাংঘর্ষিক। সংস্থাটির ক্যাম্পেইন কর্মকর্তা নাদিন আবদুল আজিজ বলেন, ‘যদি তারা সত্যিই নারীর অগ্রগতি চায়, তাহলে এ বৈষম্যমূলক প্রথাগুলো বিলুপ্ত করে প্রকৃত নিরাপত্তা প্রদানকারী আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।’
এইচ.এস/