ছবি: সংগৃহীত
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজশাহী থেকে প্রচারিত অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘পদ্মাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম’ প্রায় এক বছর ব্লক করে রাখেন। অনেক জায়গা থেকে এটি তখন পড়া যায়নি। রাজশাহী-ভিত্তিক এ সংবাদমাধ্যমের কার্যক্রম স্থানীয় 'বিএনপির নেতাদের চাপে' গতকাল সোমবার (২১শে জুলাই) থেকে বন্ধ হয়ে গেছে। রাজশাহী জেলা বিএনপির কমিটি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর দলটির প্রভাবশালী কয়েক নেতার 'চাপের কারণে ও মবের ভয়ে' মালিকপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে রাজশাহীতে কর্মরত জাতীয় গণমাধ্যমের অন্তত আটজন সাংবাদিক সুখবর ডটকমকে জানিয়েছেন।
তারা জানান, বিএনপিকে নিয়ে ওই প্রতিবেদনের জের ধরে সংবাদমাধ্যমটির প্রকাশকের বাড়িতে গিয়ে মব সৃষ্টির চেষ্টা করেন দলটির স্থানীয় পর্যায়ের কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মী। এতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় সাংবাদিকরা আতঙ্ক, উদ্বেগের কবলে পড়েন। পরে সেনাবাহিনীকে বিষয়টি জানানো হয়। সেনাবাহিনী সতর্ক থাকায় প্রকাশকের বাড়িঘর ভাংচুর, হামলা থেকে রেহাই পেলেও পত্রিকাটির প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে অন্তত ৫৭ জনের চাকরি চলে গেছে। স্থানীয় নিউজ পোর্টাল হলেও সবাইকে নিয়মিত বেতন ও সম্মানি দিত পদ্মাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের মালিকপক্ষ।
পুরান ঢাকার আলোচিত লাল চাঁদ সোহাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে কার্যালয়ের অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে সরেজমিন ঘুরে একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করেন দৈনিক যুগান্তরের নিজস্ব প্রতিবেদক আবদুল্লাহ আল মামুন। ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্থানীয় বিএনপির এক নেতার সম্পৃক্ততা বেরিয়ে আসে সাংবাদিক মামুনের প্রতিবেদনে। যা তিনি উল্লেখ করেন প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর পত্রিকা কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে। ঢাকায় কর্মরত মামুনের অনেক সহকর্মী ও সাংবাদিক ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ করছেন, 'বিএনপির এক নেতার চাপে' তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
গত বছরের ৫ই আগস্ট খুলনার স্থানীয় ‘দেশ সংযোগ’ পত্রিকার কার্যালয়ে হামলা হয়। এরপর পত্রিকাটির প্রকাশনা একটানা ১৫ দিনের মতো বন্ধ থাকে বলে সুখবরকে জানান পত্রিকাটির সম্পাদক মুন্সী মাহবুব আলম সোহাগ। পুরোনো কার্যালয় বন্ধ করে খুলনা শহরের মির্জাপুর এলাকায় একটি ভবন ভাড়া নিয়ে সেখান থেকে পরে পত্রিকার প্রকাশনার কাজ শুরু হয়। চলতি বছরের ৮ই মে ‘দেশ সংযোগ’ কার্যালয়ে আবার হামলা, ভাঙচুর ও মালপত্রে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
ওই দিন পত্রিকাটিতে প্রকাশিত একটি সংবাদে শেখ হাসিনাকে ‘প্রধানমন্ত্রী’ (ক্ষমতাচ্যুত) ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্যদের ‘সংসদ সদস্য’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় বলে হামলাকারীরা অভিযোগ করেন। হামলাকারীদের সঙ্গে স্থানীয় বিএনপির একাধিক কর্মী, সমর্থককে সেদিন দেখা যায় বলে দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের। এরপর থেকে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ আছে।
চারদিনের সফরে লন্ডনে গেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ব্রিটেনের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউজের 'রয়্যাল ইন্সটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের' আয়োজিত সংলাপে গত ১১ই জুন 'বর্তমান সরকারের সময় মিডিয়ায় ক্র্যাকডাউনের (সংবাদমাধ্যমের ওপর বল প্রয়োগ) অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'তার সরকারের সময়েই সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে দেশের সংবাদমাধ্যম, যা আগে কখনো হয়নি। ক্র্যাকডাউনের কোনো ঘটনা দেশে ঘটছে না।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদ ও স্বৈরতন্ত্রের পতন হলে স্বাধীন সাংবাদিকতা চর্চায় সরকারি বাধা কেটে যায়। কিন্তু, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর সংবাদমাধ্যমের ওপর বল প্রয়োগের ঘটনা থেমে নেই।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বিএনপিসহ দলটির বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের অনেককে দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে। দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র সুখবরকে জানায়, গত ১১ মাসে চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও হামলার অভিযোগে চার হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। তবে সাংবাদিকদের নির্যাতন, গণমাধ্যমকে হুমকি দেওয়া, সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করানোর অভিযোগে অভিযুক্ত সবাইকে দলটি থেকে বহিষ্কার করা হয়নি।
অবশ্য গত প্রায় এক বছরের মধ্যে সারাদেশে মিলিয়ে বেশ কয়েক নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি সাংবাদিকদের হুমকি দেওয়া ও নির্যাতনের অভিযোগে। সাংবাদিক নির্যাতন সংক্রান্ত অভিযোগে ঠিক কতজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে, এ বিষয়ে দলটির কাছে আলাদা পরিসংখ্যান নেই।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে শহীদ মিনারে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় দৈনিক কালবেলা ও এনটিভির উপজেলা প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ হামলার শিকার হন ওই উপজেলার বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বশির উদ্দিন ও তার দলবলের। একই জেলার বিজয়নগর উপজেলায় অবৈধ মাটির ব্যবসা নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে যুবদলের নেতার নেতৃত্বে সাংবাদিক মাইনুদ্দিন রুবেলের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে গত এপ্রিল মাসে। মাইনুদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ও দেশ রূপান্তরের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংবাদদাতা হিসেবে কর্মরত। সাংবাদিক নির্যাতনে অভিযুক্ত এসব নেতাকে বিএনপি বহিষ্কার করেনি বলে জানা গেছে।
‘দেশ সংযোগ’ পত্রিকার কার্যালয় থেকে মালপত্র বাইরে এনে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, গত মে মাসে। ফাইল ছবি
গত এপ্রিলে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে বিএনপির এক নেতার বিরুদ্ধে সাংবাদিককে মারধরের হুমকির অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ভুক্তভোগী সাংবাদিক। দৈনিক ইত্তেফাকে একটি সংবাদ প্রকাশের জের ধরে সিঙ্গাইর পৌর বিএনপির প্রচার সম্পাদক নূরে আলম বাবুল ইত্তেফাকের সিঙ্গাইর উপজেলার প্রতিনিধি মানবেন্দ্র চক্রবর্তীকে হুমকি দেন।
এ বছরের ২৬শে ফেব্রুয়ারি চাঁদাবাজি ও জমি দখল নিয়ে ফেসবুকে লেখালেখি করায় ঠাকুরগাঁওয়ে এক সাংবাদিককে মারধর করার অভিযোগ ওঠে স্থানীয় বিএনপির এক নেতার বিরুদ্ধে। মারধরের শিকার সাংবাদিকের নাম মামুন অর রশিদ। তিনি দৈনিক দেশবাংলা নামক একটি পত্রিকার ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি। অভিযুক্ত ওই নেতার বিরুদ্ধে স্থানীয় বিএনপি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ সাংবাদিকদের।
ঢাকার মিটফোর্ডে সোহাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখা আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রতিবেদনটি গত ১২ই জুলাই যুগান্তরের ছাপা ও অনলাইন সংস্করণে ‘আদিম বর্বরতা: পাথর নিক্ষেপে হত্যা- বিএনপির চাঁদার বলি ব্যবসায়ী সোহাগ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটির বিষয়ে প্রতিবাদ জানায় বিএনপি। এ বিষয়ে যুগান্তরের সম্পাদককে আইনি নোটিশও পাঠায় দলটি। এরপর সাময়িক চাকরিচ্যুতির নোটিশ পান মামুন।
যুগান্তরের একাধিক সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুখবরকে বলেন, আলোচ্য প্রতিবেদনের শিরোনামের কারণে বিএনপির বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে অভিযোগের একটা বার্তা আছে, এটা সত্য। তবে বিএনপির কোন নেতা যুগান্তর কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়েছেন মামুনকে চাকরিচ্যুত করতে, বিষয়টি কেন্দ্রীয় বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কেউ কেউ জানেন। কিন্তু তারা অভিযুক্ত ওই নেতার বিরুদ্ধে গত নয় দিনের মধ্যে কোনো ব্যবস্থা নেননি।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা বলছেন, গত বছরের আগস্টে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাকে নিয়ে আঁকা ঢাকার কার্টুনিস্ট মেহেদি হাসানের একটি ব্যঙ্গ কার্টুনকে প্রশংসিত করেন। তিনি মেহেদি হাসানের ওই কার্টুন নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে শেয়ার করে দেশে রাজনৈতিক কার্টুন আঁকার স্বাধীনতা নিয়ে মন্তব্য করেন। যা সাংবাদিক ও বোদ্ধা মহলে প্রশংসিত হয়। কিন্তু, সারাদেশের একশ্রেণির নেতাকর্মীকে নিয়ন্ত্রণে বিএনপি সফল হতে পারছে না। এসব নেতাকর্মী সাংবাদিক ও গণমাধ্যম নির্যাতন বিষয়ক ঘটনায় একের পর এক সমালোচনার জন্ম দিচ্ছেন।
এদিকে, রাজশাহী-ভিত্তিক ‘পদ্মাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম’ সম্পাদক এম বদরুল হাসান বলেন, ‘প্রকাশক আজিজুল আলম বেন্টুর নির্দেশে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সরকারি নিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল পদ্মাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সব কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য যেমন বেদনার, তেমনি পাঠকদের জন্যও কষ্টদায়ক। সবার কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা ও সহানুভূতি কামনা করছি।’
পদ্মাটাইমস ২০১৭ সালের ১লা জানুয়ারি যাত্রা করে। ২০২২ সালের ২১শে জুলাই এটি সরকার নিবন্ধিত হয়। এর প্রকাশক মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল আলম বেন্টু। গত বছরের ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তিনি পলাতক। ওই দিন পদ্মাটাইমসের কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়েছিল। আজিজুল ২০২২ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিলেন। এরপর তাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হলেও দলীয় রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন না।
বদরুল হাসান বলেন, 'সম্প্রতি জেলা বিএনপির কমিটি নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। এতে সংশ্লিষ্ট সবার বক্তব্য ছিল। এরপরও কোনো বিষয়ে আপত্তি থাকলে তারা প্রতিবাদ জানাতে পারতেন। কিন্তু তারা নাখোশ হয়ে প্রকাশকের বাড়িতে গিয়ে মব সৃষ্টির চেষ্টা করেন। পরে সেনাবাহিনীকে বিষয়টি জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মালিকপক্ষ এটি বন্ধ করে দেয়। এতে অন্তত ৫৭ জনের চাকরি চলে গেছে। স্থানীয় নিউজ পোর্টাল হলেও সবাইকে কিছু না কিছু সম্মানি দেওয়া হতো।’
যোগাযোগ করলে রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ মুঠোফোনে সুখবরের কাছে এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে দাবি করেন, ‘পদ্মাটাইমস আমাকে নিয়ে যত খারাপ দিক আছে, সেগুলো লিখেছে। তারা যেগুলো সত্য, সেগুলোও লিখেছে, যেগুলো মিথ্যা, সেগুলোও লিখেছে। আমি কিছুই বলিনি। আমি সাংবাদিকদের খুব সম্মান করি। রাজশাহীতে এ নিউজ নিয়ে একটা টুঁ শব্দও করিনি। আমার জানামতে, কেউ সাংবাদিকদের হুমকি দেননি। কেউ কারো বাড়িতে গিয়েও হুমকি দেননি। তারা হয়তো নিজেরাই ওটা বন্ধ করে দিয়েছে।’
রাজশাহী সাংবাদিক সংস্থার সভাপতি জাহিদ হাসান বলেন, 'পদ্মাটাইমস রাজশাহী অঞ্চলের সংবাদনির্ভর পোর্টাল। এই পোর্টালে জানামতে মালিকপক্ষের প্রভাব খুব বেশি ছিল না। একটি প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে পোর্টালটি বন্ধ করা কাম্য নয়। এখানে অনেক মানুষের রুটি-রুজির ব্যাপার জড়িত।'
খবরটি শেয়ার করুন