প্রতীকী ছবি
বিদায় নিল ১৪৪৫ হিজরি। রোববার (৭ই জুলাই) সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল নতুন আরবি বছর; ১৪৪৬ হিজরি। ইসলাম মতে, আসমান, জমিন সৃষ্টির পরপরই বারো মাসে বছর গণনার পদ্ধতি নির্ধারিত হয়।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় বারোটি মাস আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে।’ (সুরা তওবা: ৩৬)
পবিত্র কুরআনে আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই (আল্লাহ) সূর্যকে দীপ্তিময় ও চাঁদকে আলোকময় করেছেন এবং তার জন্য কক্ষপথ নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো।’ (সুরা ইউনুস: ৫)
প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়, বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে সন গণনা শুরু হতো। যেমন, হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সম্প্রদায়ের লোকেরা হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে আগুনে নিক্ষেপ করার দিন থেকে সন গণনা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে বায়তুল্লাহ নির্মাণের পর তা বিলুপ্ত হয়ে নতুন করে আবার সন গণনা শুরু হয়। একসময় এসে এই সন গণনা বিলুপ্ত হয়ে যায়। ইসলামের আগমনের আগে সর্বশেষ আবরাহার হস্তিবাহিনী পবিত্র কাবা ধ্বংস করতে এসে আবাবিল পাখির পাথরবৃষ্টির মাধ্যমে নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যায়। তৎকালীন আরবে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সন গণনা শুরু হয়। কিন্তু বর্তমানে আমরা যে সন গণনা করি, তার সূচনা হয় একটু ভিন্নভাবে।
দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.)-এর সময়কালে বসরার গভর্নর আবু মুসা আশআরি (রা.) খলিফার কাছে এক পত্রে লেখেন, ‘হে আমিরুল মুমিনিন, আমাদের কাছে বহু পত্র আসে, যাতে তারিখ লেখা থাকে শাবান। কিন্তু তা কি বর্তমান বছরের, নাকি অতীতের—আমরা বুঝতে পারি না। তারপর ওমর (রা.) সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। (ইবনুল আসির, আল-কামিল ফিত-তারিখ: ১/৮)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন ওমর (রা.) সন প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি পরামর্শ সভার আহ্বান করেন। সভায় সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) নবীজি (স.)-এর ইন্তেকালের বছর, তালহা (রা.) নবুয়াতের বছর, আলী (রা.) হিজরতের বছর থেকে বর্ষ গণনার প্রস্তাব দেন। এরপর উপস্থিত সবাই আলী (রা.)-এর প্রস্তাবে ঐকমত্য পোষণ করেন।’ (আল-আইনি, উমদাতুল কারি: ১৭/৬৬)
সন গণনা শুরুর জন্য নবীজি (সা.)-এর জন্ম, মৃত্যু, নবুয়ত ও হিজরত—চারটি প্রস্তাব এসেছিল। বস্তুত জন্ম ও নবুয়াতের সন নিয়ে বিভিন্ন মতামত আছে। তাই অগত্যা হিজরতের মাধ্যমেই সাল গণনা শুরু করা হয়। (ইবনে হাজার আসকালানি, ফাতহুল বারি: ৭/২৬৮)।
এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। সেটা হলো, নবী কারিম (স.) হিজরত করেন রবিউল আউয়াল মাসে। তাহলে বছরের প্রথম মাস মহররম হলো কীভাবে? এর উত্তরে কেউ কেউ বলেন, যখন মক্কায় মুশরিকরা মুসলমানদের ওপর নির্যাতন সীমাতিরিক্ত করতে লাগল, তখন আল্লাহ ও নবীর আদেশে সর্বপ্রথম যে দলটি আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন- তখন ছিল মহররম মাস। এজন্য হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম।
তবে গ্রহণযোগ্য মতানুযায়ী, নবীজি (স.)-এর হিজরত ২৭ সফর থেকে শুরু করে ১২ রবিউল আউয়াল অবধি সম্পন্ন হয়েছিল। বর্ষ গণনার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ১৭তম বছরের ১০ জুমাদাল উলা মাসে। মাস হিসেবে রবিউল আউয়াল কিংবা জুমাদাল উলা কোনোটি থেকে বর্ষ গণনা শুরু হয়নি। সমকালীন আরবে মহররম ছিল প্রথম মাস। পরিস্থিতি বিবেচনায় শৃঙ্খলা রক্ষার্থে তা অপরিবর্তিত রাখা হয়।’ (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ৪/৫১৭)
আরেকটি বিষয়, হিজরি সনের সম্পর্ক চাঁদের সঙ্গে। বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মুসলমান এই সন ব্যবহার করে থাকেন। বছরে বারো মাস যেভাবে আল্লাহ নির্ধারণ করেছিলেন, তেমনি মাসের দিনক্ষণও আল্লাহ নির্ধারণ করেন। মাস ঊনত্রিশ দিনের হবে নাকি ত্রিশ দিনের হবে, তা মহান আল্লাহ নির্ধারণ করে দেন। এই ফায়সালা হয় প্রতিমাসে নতুন চাঁদ উদিত হওয়ার মাধ্যমে। আল্লাহর ফয়সালার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস কারো নেই। তাইতো মাসের ঊনত্রিশতম দিনে আমাদের চেয়ে থাকতে হয় চাঁদের দিকে। কবে উদিত হচ্ছে নতুন মাসের চাঁদ। যদি উদিত না হয়, তাহলে এই মাস হবে ত্রিশ দিনে। আর উদিত হলে হবে ঊনত্রিশ দিনে। কিন্তু ইংরেজি মাস কিংবা বাংলা মাসের তারিখ মানুষের নিজেদের তৈরি পদ্ধতিতে হয়।
হিজরি সনের মাসগুলো হলো- মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ।
৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিজরি সন প্রবর্তিত হলে তার এক বছরের মধ্যে তা আমাদের এই বাংলাদেশে চলে আসে আরব বণিকদের হাত ধরে। হিজরি সন প্রবর্তনের বছর বা তার পরের বছর এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয় এবং হিজরি সনও স্বাভাবিকভাবে আমাদের দেশে প্রচলিত হয়। এই হিজরি সন আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় সন হিসেবেও প্রচলিত হয়েছিল, যা ৫৫৬ বছর স্থায়ী হয়েছিল। এখনও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে হিজরি সনের প্রভাবই বেশি। ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান হিজরি সন, আরবি তারিখ ও চান্দ্রমাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠান, আনন্দ-উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ হিজরি সনের ওপর নির্ভরশীল। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও মুসলিম জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম।
হিজরি নববর্ষের শিক্ষা হলো ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও মানবতার জন্য ত্যাগ স্বীকার। এই দিনে ব্যক্তি পুরনো বছরের আত্মপর্যালোচনা এবং নতুন বছরের কর্মপরিকল্পনা সাজিয়ে নব উদ্যমে কর্মতৎপর হতে পারে। নববর্ষের শুরুতে শুভেচ্ছা বিনিময় করে পরস্পরের কল্যাণ কামনা করতে পারে। ইসলামে অশুভ ও কুলক্ষণের চর্চা না থাকলেও শুভ ও কল্যাণের ধারণা আছে।
আনাস (রা.) বলেন, নবী (স.) বলেছেন, ‘ইসলামে সংক্রামক ব্যাধি আর কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই। তবে ‘ফাল’ (শুভ লক্ষণ) আমাকে আনন্দিত করে। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ফাল’ কী? তিনি বলেন, ‘উত্তম বাক্য’। (সহিহ বুখারি: ৫৭৭৬)
অর্থাৎ সুন্দর শব্দ ও উত্তম বাক্য শুনে মনে মনে কল্যাণের আশা পোষণ করা বৈধ। এজন্য রাসূল (স.) এর জীবনের আদর্শ অনুসরণের জন্য কোরআন-হাদিসের পাশাপাশি বছরব্যাপী সিরাত-সাহিত্য অধ্যয়নের পরিকল্পনা নিতে পারে মুসলিম উম্মাহ। এই নববর্ষ হোক জীবনকে ঢেলে সাজানোর নতুন আত্মপ্রত্যয়।