ফাইল ছবি
দেশের জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণে সরকারের গঠিত আট সদস্যের কমিটির আসল দায়িত্ব কী, বিষয়টি অনেক সাংবাদিকের কাছে স্পষ্ট নয়। কমিটির কোনো কাজও তাদের কাছে সেভাবে দৃশ্যমান নয়। এই কমিটি গঠনের পর প্রায় ১৫ মাস পার হয়ে গেলেও এর মাধ্যমে মামলার শিকার ও কারাবন্দী সাংবাদিকদের উপকৃত হওয়ার তথ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রায় দেড় বছর পর হত্যা ও সহিংসতার মামলার বেড়াজালে জড়িয়ে আছে অন্তত ২৯৬ জন সাংবাদিকের নাম। অথচ কমিটি প্রায় দেড় বছরে পেয়েছে মাত্র ৭২ জন সাংবাদিকের নাম। অনেক সাংবাদিক হয়রানিমূলক মামলার শিকার হলেও কমিটি তাদের খবর পায়নি। এই কমিটির পাঠানো ৭২ জনের তালিকাও আটকে আছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ না পাওয়া গেলে কোনো মামলা থেকে অভিযুক্তের নাম বাদ দেওয়ার ক্ষমতা চলতি বছর অধ্যাদেশ জারি করে দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। এখন পর্যন্ত কোনো সাংবাদিক এই সুবিধা পাননি। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিকদের হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানে রয়েছে। মামলার শিকার কোনো কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গত সরকারের আমলে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নেওয়া ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হওয়া নিয়ে শুরু থেকেই নানা প্রশ্ন আছে।
সরকারের কমিটির দায়িত্ব হবে গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণ করা ও সময়ে সময়ে মামলার বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা, এমন আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে কমিটি গঠিত হয়েছিল। ২০২৪ সালের ৭ই অক্টোবর তথ্য মন্ত্রণালয় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া হয়রানিমূলক মামলার পুনর্মূল্যায়নের জন্য এ কমিটি গঠন করে। এরপর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ১লা জুলাইয়ের পর দায়ের হওয়া মামলার বিস্তারিত ও প্রমাণাদি জমা দিতে বলা হয়, ব্যক্তিগতভাবে বা সম্পাদকদের মাধ্যমে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম এসব প্রসঙ্গে বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আমাদের অপমান করছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সাংবাদিকদের ওপর সবচেয়ে বড় বিচারিক হয়রানি হতে দিয়ে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই ১৮ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও লজ্জাজনক বাস্তবতা হলো, অন্তত ২৯৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে—যার অনেকগুলোই হত্যার অভিযোগে—যেসব মামলায় তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তদন্তই হয়নি, কিংবা আজ অব্দি কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এদিকে সরকারের গঠিত পুনর্মূল্যায়ন কমিটি মাত্র ৭২টি মামলা খুঁজে পেয়েছে বলে জানান বাংলাদেশের ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টসের একাংশের সাবেক সভাপতি এম আব্দুল্লাহ। তিনি পুনর্মূল্যায়ন কমিটিরও সদস্য ছিলেন। এম আব্দুল্লাহ ২৮শে সেপ্টেম্বরের এক আলোচনায় জানান, বেশিরভাগ মামলাই ঢাকার বাইরের। এগুলো ব্যক্তিগত বিবাদ থেকে করা, রাজনৈতিক হয়রানির জন্য করা নয়।
সেই আলোচনা অনুষ্ঠানে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, 'যদি একজন সাংবাদিক প্রতিশোধমূলক মামলার শিকার হন, আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে। তবে আমাদের মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তাই আমরা আরও তদন্ত করতে তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।'
ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম এসব প্রসঙ্গে বলেন, গত বছর তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণে ওই কমিটি গঠন করেছিল সরকার। ওই বছরের ২৭শে অক্টোবর সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়, তারা যেন হয়রানির প্রমাণসহ তথ্য জমা দেন। কমিটি ৭২টি মামলার তথ্য সংগ্রহ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।
তিনি বলেন, চলতি বছরের ২৮শে সেপ্টেম্বর এক বৈঠকে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, আমরা ৭২ জন সাংবাদিকের নাম পেয়েছি। আমাদের মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার না থাকায় তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি তদন্তের জন্য। তার মানে, সেখানেই বিষয়টি আটকে আছে। কমিটি গঠনের পর এতগুলো মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, চলতি বছর আইন মন্ত্রণালয় একটি অধ্যাদেশ জারি করেছে, যেখানে প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ না পাওয়া গেলে মামলা থেকে অভিযুক্তের নাম বাদ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। আগে এর জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন প্রয়োজন হতো। অথচ, এখন পর্যন্ত কোনো সাংবাদিক এই সুবিধা পাননি।
গত ২৬শে জুন এক আলোচনায় আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ঠেকানোর এখতিয়ার আইন মন্ত্রণালয়ের নেই—হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগের ক্ষেত্রেও না। কারণ, বাংলাদেশে যে কেউ মামলা করতে পারেন।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল ও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরই আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষে মামলা প্রত্যাহার করা সম্ভব। তিনি বলেন, 'পুলিশ মামলার তদন্ত শুরু করলে তখন আইন মন্ত্রণালয় আর কিছুই করতে পারে না। এটা পুলিশের দায়িত্ব।'
মাহফুজ আনাম এ প্রসঙ্গে বলেন, কিন্তু, আমাদের প্রশ্ন হলো, যেখানে আইন অপব্যবহারের বিষয়টি স্পষ্ট, সেখানেও কি সরকার বাধা দিতে পারে না? আমাদের বিশ্বাস, কর্তৃপক্ষ চাইলে সহজেই তদন্ত করে দেখতে পারত যে, এই মামলাগুলোর অধিকাংশই প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। কিছু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দলীয় সাংবাদিকতা বা এমনকি দুর্নীতির অভিযোগ থাকতে পারে এবং এর জন্য তাদের উপযুক্ত আইনে বিচার ও শাস্তি দেওয়া সম্ভব। কিন্তু তাই বলে তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দিতে হবে?
তিনি বলেন, সরকার যদি এই নীতি গ্রহণ করত যে, ভুয়া মামলা করা অপরাধ এবং যারা এই অধিকারের অপব্যবহার করেছে তাদের শাস্তি দিত, তাহলে হয়রানি ও চাঁদাবাজির এই দ্বার খুলতো না এবং আইনের এতটা লজ্জাজনক, ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিত অপব্যবহার হতো না।
তথ্যমতে, জুলাই অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিভিন্ন হত্যা মামলায় সাংবাদিকদের আসামি করা হয়েছে। এসব মামলা পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ‘গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণ–সংক্রান্ত কমিটি’ গঠন করে সরকার।
কমিটির সভাপতি হিসেবে আছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রচার)। সদস্য হিসেবে আছেন তথ্য অধিদপ্তরের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা, আইন ও বিচার বিভাগের একজন প্রতিনিধি (জেলা জজ পদমর্যাদার), চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) মহাপরিচালক, বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সচিব। কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে আছেন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রেস)।
প্রসঙ্গত, সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্বের বাইরে ব্যক্তিগত দায় রয়েছে এমন কোনো মামলার তথ্য পর্যবেক্ষণ কমিটির কাছে প্রেরণ করা যাবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমেই বলা হয়েছিল। ডেইলি স্টারের তৈরি করা ২৯৬ জনের তালিকায় থাকা সাংবাদিকদের প্রায় ২০ শতাংশের আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক ছিল—যাদের কেউ কেউ দলটির প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন, কেউ কেউ ছিলেন সংগঠনের পদে, সরকারের অনৈতিক সুবিধাও নিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও আছে।
তাদের মধ্যে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জের কমল খান ও রাজু আহমেদ। তারা সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ। একজনকে শামীম ওসমানের সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে দুটি বন্দুক নিয়ে গুলি করতেও দেখা গেছে। অন্যান্য ১৩ জনের মধ্যে আছেন নাঈমুল ইসলাম খান, যিনি ছিলেন শেখ হাসিনার প্রেস সচিব। অভিযুক্ত সাংবাদিকেরা ৫৩টি মিডিয়া হাউসের সঙ্গে যুক্ত, যার মধ্যে রয়েছে ৩০টি জাতীয় পত্রিকা ও টেলিভিশন স্টেশন। মামলায় অভিযুক্ত সাংবাদিকদের মধ্যে প্রায় ৭৪ শতাংশ ঢাকার বাইরের।
খবরটি শেয়ার করুন