বুধবার, ৮ই অক্টোবর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** দুদকের মামলার আসামি হওয়ার একদিন পর ট্রাইব্যুনালের ‘বিচারক’ *** ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের বক্তব্য ‘অযৌক্তিক’: তৌহিদ হোসেন *** ১৫–১৮ই নভেম্বরের মধ্যে গণভোট সম্ভব, হিসাব দিলেন জামায়াত নেতা তাহের *** ‘সেফ এক্সিটের তালিকার শীর্ষে কোন উপদেষ্টারা’ *** শহিদুল আলমের প্রতি সহমর্মিতা প্রেস সচিব শফিকুল আলমের *** উপদেষ্টাদের মধ্যে কারা সেফ এক্সিট নিতে চায়, সেটি নাহিদ ইসলামকেই পরিষ্কার করতে হবে: রিজওয়ানা হাসান *** পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা কিছুটা কমেছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা *** শহিদুল আলমকে ‘অপহরণ’ করেছে দখলদার ইসরায়েল *** ‘ফ্রি শহিদুল আলম’, মির্জা ফখরুলের পোস্ট *** বেবি পাউডারে ক্যানসারের উপাদান, জনসন অ্যান্ড জনসনকে ৯৬ কোটি ডলার জরিমানা

‘সেফ এক্সিটের তালিকার শীর্ষে কোন উপদেষ্টারা’

বিশেষ প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০৮:৫১ অপরাহ্ন, ৮ই অক্টোবর ২০২৫

#

ছবি: সংগৃহীত

গত দুই–তিন দিন ধরে একটি বিষয় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে—তা হলো ‘সেফ এক্সিট’ (নিরাপদ প্রস্থান)। বলা হচ্ছে, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা, অর্থাৎ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদের  সদস্যরা সেফ এক্সিটের পথ খুঁজছেন। এ জন্য তারা বিভিন্ন মহলের সঙ্গে, বিশেষ করে যেসব রাজনৈতিক দল আগামীতে ক্ষমতায় আসতে পারে—তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন, যেন ভবিষ্যতে বেকায়দায় না পড়েন। অর্থাৎ, তাদের যেন জবাবদিহির মুখোমুখি হতে না হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার পর কি উপদেষ্টাদের জীবনের নিরাপত্তা এতটা ঝুঁকিতে পড়ে যে, পালিয়ে যেতে হয়? ক্ষমতা ছাড়ার পর সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করাই হচ্ছে আসল সৌন্দর্য। তাহলে কেন এমন ভয়ের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে? সেফ এক্সিট কেন এত গুরুত্ব পাচ্ছে? অনেকের দাবি, অধিকাংশ উপদেষ্টা ডুয়েল সিটিজেনশিপ (দ্বৈত নাগরিকত্ব) নিয়ে চলছেন। সরকারের মেয়াদ শেষে তাদের একটা বড় অংশই দেশের বাইরে চলে যেতে পারবেন। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দেশগুলোতেই তারা আবারও ফিরে যাবেন। তাদের এক্সিট রুট খুঁজতে খুব কষ্ট করতে হবে না।

এরপরও আলোচনা থামছে না। ধারণা করা হচ্ছে, উপদেষ্টারা রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এমন আশ্বাস চাইছেন, যেন ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তনের পর তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা না নেওয়া হয় এবং তারা নিরাপদে দেশ ছাড়তে পারেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সেফ এক্সিট নিয়ে আলোচনা নতুন কিছু নয়। ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ড. ফখরুদ্দীন আহমদ দায়িত্ব শেষে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার তখন তাদের সেফ এক্সিট দেয়। তাদের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়নি। এখন সেফ এক্সিটের তালিকার শীর্ষে কোন উপদেষ্টারা আছেন, এমন হিসাব-নিকাশও করছেন অনেকে।

বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, বর্তমান উপদেষ্টারাও কি সেই একই ধরনের সেফ এক্সিট চাইছেন? সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নাহিদ ইসলাম তার বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের অভ্যন্তরীণ সংকটের কথা তুলে ধরেন। তার ভাষায়, উপদেষ্টাদের অনেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছেন। তারা নিজেদের ‘সেফ এক্সিট’-এর কথা ভাবছেন। নাহিদ তার বক্তব্যে স্বীকার করেন, রাজনৈতিক দল ও উপদেষ্টাদের প্রতি অতিরিক্ত বিশ্বাসই ছিল বড় ভুল। তার ওই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মূলত রাজনীতিতে সেফ এক্সিট নিয়ে আলোচনা জোরেশোরে চলছে।

কেউ কেউ বলছেন, কেন সম্ভাবনাময় তরুণদের উপদেষ্টারা সঠিক পরামর্শ দেননি? কেন ভালো নেতৃত্বের অভাবে তারা এই অবস্থায় পড়লেন? নাহিদরা এমন সব উপদেষ্টার খপ্পরে পড়েছিলেন, যারা চরিত্রহীন, ব্যক্তিগত জীবনে ব্যর্থ ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। তরুণ নেতারা অনেক সময় সরল বিশ্বাসে সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রতারিত হন। তাই এখন সময় এসেছে, সত্য প্রকাশ করার। নাহিদ, সারজিস, হাসনাতদের উচিত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সত্য কথা জাতির সামনে তুলে ধরা। কারা প্রতারণা করেছেন, কারা দলের ক্ষতি করেছেন, যেন ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের ভুল না করেন।

তবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মনে করেন, উপদেষ্টাদের মধ্যে কারা সেফ এক্সিট নিতে চায়, এ বিষয়গুলো নাহিদ ইসলামকেই পরিস্কার করতে হবে। তিনি যদি কখনও পরিষ্কার করেন, তখন সেটি নিয়ে সরকারের বক্তব্যের কথা আসে। তার আগে এটি নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ সরকারের নেই। নাহিদ ইসলামের বক্তব্য তাকেই খণ্ডন করতে হবে, এটা সরকারের খণ্ডানোর বিষয় নয়। বক্তব্যটা স্পেসিফিক (সুনির্দিষ্ট) হলে হয়তো সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কথা বলা হতো।

গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আব্দুন নূর তুষার বলেন, বর্তমান উপদেষ্টারা প্রস্থান করবেন এবং প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গেই সাধারণ মানুষ হয়ে যাবেন—এটাই প্রস্থানের সৌন্দর্য। তারা ক্ষমতায় থাকাকালীন এক রূপে ছিলেন আর ক্ষমতার বাইরে এসে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়াই তো ক্ষমতার আসল সৌন্দর্য। কিন্তু সেই সৌন্দর্য বাদ দিয়ে নাহিদ-সারজিসরা বারবার বলছেন, ‘ক্ষমতা ছেড়ে দিলে মৃত্যু সামনে দাঁড়িয়ে আছে'—এভাবে ভয় দেখানোর মানে কী? আমার মনে হয়েছে, আজ যে উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেখানে আরো কিছু সমস্যা আছে।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ‘আব্দুন নূর তুষার যথার্থই বলেছেন। উপদেষ্টাদের দায়িত্ব থেকে চলে যাওয়া হচ্ছে ক্ষমতার সৌন্দর্য। ক্ষমতায় দায়িত্ব পালন করেছি আর দায়িত্ব শেষ হলে সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন—এটাই আসল সৌন্দর্য। নাহিদ ইসলাম ও সারজিস আলম বলছেন, কিছু উপদেষ্টার সেফ এক্সিট প্রয়োজন হবে। কারণ, তারা দুর্নীতিতে জড়িত। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। উপদেষ্টাদের মধ্যে কয়েকজনকে নিয়েই আলোচনা হয়। বিষয়গুলোতে যদি ড. ইউনূস একটু কঠোর হতেন, তাহলে নিয়ন্ত্রণ করা যেত। তিনি হয়তো ভাবছেন—‘যাক, কয় দিন আছি, বিতর্কের মধ্যে না যাই, তাদের কষ্ট না দিই।’

সেফ এক্সিটের তালিকা করলে সবার ওপরে ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার নাম থাকবে বলে দাবি রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামালের। তার মতে, আসিফ মাহমুদ যেখানে যান, সেখানেই বিতর্ক তৈরি করেন। দুই দিন আগে বিসিবির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। এই লোকের ঝামেলার শেষ নেই। এত ছোট বয়সে এত বড় বড় দায়িত্ব দেওয়ার ফলে সে যে কি পরিমাণ বিতর্ক সৃষ্টি করেছে, তা ভাবাই যায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের যদি মিনিমাম সেন্স থাকত, তাহলে আসিফ মাহমুদকে সবার আগেই বিদায় করত। এর পুরো দায় সরকারের ওপরই বর্তাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, শুধু আসিফ মাহমুদের বিরুদ্ধেই যে এ ধরনের অভিযোগ উঠবে তা নয়— ‘সেফ এক্সিট’-এর আলোচনা আরো অনেক উপদেষ্টাকে ঘিরেও হবে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন উপদেষ্টার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ দুর্নীতি, অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলেও অভিযোগ রয়েছে। এই সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার অন্তত ১৫ দিন আগে তাদের পাসপোর্ট জব্দ করা উচিত।

তার মতে, এরপর তদন্ত করে দেখতে হবে—কাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ আছে। যদি কেউ নির্দোষ প্রমাণিত হয় তবে তাকে মুক্তি দিতে হবে; আর দোষী হলে তাদেরকে অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। আমরা সব দুষ্ট লোককে বিচারের মুখোমুখি দেখতে চাই; দুষ্ট লোক কেন দায়িত্বে থাকবে, তা আমরা মেনে নেব না।

বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা বলেন, উপদেষ্টারা অনেকেই সেফ এক্সিট খুঁজছেন। আমার মনে হয়, সেফ এক্সিট খুঁজতে উপদেষ্টাদের খুব কষ্ট করতে হবে না, কারণ ম্যাক্সিমাম উপদেষ্টা ডুয়েল সিটিজেনশিপ নিয়ে চলছেন। তাদের একটা বড় অংশই দেশের বাইরে অটোমেটিক্যালি চলে যেতে পারবেন। শুধু দেশের বাইরে তো নয়, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দেশগুলোতেই তারা আবারও ফিরে যাবেন। এজন্য তাদের খুব একটা এক্সিট রুট খুঁজতে খুব কষ্ট করতে হবে, তেমনটিও নয়। রাজনৈতিক দলগুলো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে ব্যর্থ হলে দেশ একটি গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। এটা সহজেই অনুমেয়।

সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি প্রশ্ন তোলেন, কেন সম্ভাবনাময় তরুণদের কেউ সঠিক পরামর্শ দেননি? কেন ভালো নেতৃত্বের অভাবে তারা এই অবস্থায় পড়লেন? তিনি দাবি করেন, নাহিদরা এমন সব উপদেষ্টার খপ্পরে পড়েছিলেন, যারা চরিত্রহীন, ব্যক্তিগত জীবনে ব্যর্থ ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। তরুণ নেতারা অনেক সময় সরল বিশ্বাসে সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রতারিত হন। তাই এখন সময় এসেছে, সত্য প্রকাশ করার।

তিনি বলেন, নাহিদ, সারজিস, হাসনাতদের উচিত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সত্য কথা জাতির সামনে তুলে ধরা। কারা প্রতারণা করেছেন, কারা দলের ক্ষতি করেছেন, যেন ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের ভুল না করেন। গত ১৪ মাসে যা ঘটেছে, তার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। সময় এসেছে সবকিছু সামনে আনার। নাহিদরা এখনো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন, মিডিয়ায় জায়গা পাচ্ছেন।

রুমিন ফারহানা মাসুদ কামাল গোলাম মাওলা রনি মোস্তফা ফিরোজ সেফ এক্সিট আব্দুন নূর তুষার

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন

Footer Up 970x250