ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পর কোনো গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বিবিসি বাংলাকে দেওয়া দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৌশল, আওয়ামী লীগের রাজনীতি, দলটির নেতাকর্মীদের বিচার, দেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কসহ সমসাময়িক নানা বিষয়ে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরেছেন তারেক রহমান। তার সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব গতকাল সোমবার এবং দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব আজ মঙ্গলবার (৭ই অক্টোবর) বিবিসি বাংলা প্রচার করেছে।
দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের মূল্যায়ন করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, একজন জাতীয় নেতার কাছে জনগণ যে আন্তরিকতা খুঁজতে চায়, তারেক রহমান সে প্রত্যাশার কাছাকাছি নিজেকে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন আন্তরিকভাবে। অনেক দিন পরে আকাঙ্ক্ষিত এই সাক্ষাৎকারে তিনি বেশ ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। স্বল্প কথায় তিনি উত্তর দিয়েছেন। কোনো বক্তব্যকেই খুব দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করেননি। কোনো বক্তব্য দিয়েই তিনি বিতর্কে জড়াতে চাননি। এই সাক্ষাৎকারে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে, যা শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং দার্শনিক ও নৈতিক প্রশ্নেরও জন্ম দেয়। এতে প্রকৃত রাষ্ট্রনায়কের মতো কথা বলেছেন তারেক রহমান।
তাদের মতে, আগে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় তারেক রহমান তার দলের নেতৃত্বের শীর্ষে যেমন ছিলেন না, তেমনি তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ঝুলিও বর্তমানের মতো সমৃদ্ধ ছিল না। বিবিসির অনির্ধারিত প্রশ্নোত্তর, ১৭ বছরের লম্বা বিরতি, জমে থাকা হাজারো প্রশ্ন, বিব্রতকর জিজ্ঞাসা, ব্যক্তিগত–পারিবারিক তথ্যানুসন্ধান, সুদীর্ঘ কথোপকথন—এই সবকিছুর মুখোমুখি হয়ে কতটা সপ্রতিভ থাকতে পারবেন তিনি, সে জিজ্ঞাসা ছিল অনেকেরই। স্বচ্ছন্দেই সব প্রশ্ন সামলেছেন তিনি। উত্তর দেওয়ার সময় তার মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। তারেক রহমান অন্তর দিয়ে যেটা বিশ্বাস করেন, সেটাই বলেছেন নির্দ্বিধায়। প্রচলিত রাজনীতিতে অস্পষ্টতা রেখে, পরোক্ষ বা গা বাঁচানো উত্তর দেওয়াটাই যখন প্রায় প্রথাসিদ্ধ বলেই সবাই জানেন, সেখানে তিনি প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদের মতো কথা বলেছেন।
বিশ্লেষকেরা বলেন, তারেক রহমান বিবিসি বাংলার কোনো প্রশ্ন পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছেন এমনও নয়, কথা বলেছেন বলিষ্ঠ আত্মবিশ্বাসী অবস্থান থেকে। এটা তার অনুসারী, দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দীপ্ত করবে। কথা বলার সময় তিনি যতটা না দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের অবস্থান থেকে কথা বলেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সচেষ্ট ছিলেন তার কথোপকথনে জাতীয় ঐক্যের সুর যেন আরও বেশি বলিষ্ঠ শোনা যায়। তার বক্তব্যের এ ধারা দেশের রাজনৈতিক সুস্থতার জন্য অনেক প্রয়োজন। প্রতিপক্ষকে অনাবশ্যক আক্রমণের সুযোগ যেমন নেননি, তেমনি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে এক সাধারণ মানুষের মতো ভদ্রোচিত অস্বস্তিতে ছিলেন, যেন তার কোনো কথাতেই আত্মম্ভরিতা বা অহংকার প্রকাশিত না হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, সাবেক রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর সন্তান, এমন সৌভাগ্যের সঙ্গে জনগণকে তাচ্ছিল্য করার প্রচলিত সংস্কৃতির সঙ্গে প্রায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া দর্শক–শ্রোতাকে আবারও সেই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়নি তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারে, সেটাও এ সাক্ষাৎকারে অন্যতম প্রাপ্তি। তার দেশে ফেরা নিয়ে এত দিন যে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে দলের নেতা-কর্মীরা প্রায়ই অস্পষ্টতার আশ্রয় নিতেন, সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই সেটা স্পষ্ট করেছেন অনেকটাই। বলেছেন, ‘কিছু সংগত কারণে এখনো দেশে ফেরা হয়ে ওঠেনি। এখন ফেরার সময় চলে এসেছে। দ্রুতই দেশে ফিরব ইনশা আল্লাহ।’ তিনি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি। বলেছেন, এখানে মাস্টারমাইন্ড কোনো ব্যক্তি বা দল নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও তৃতীয় মাত্রার উপস্থাপক জিল্লুর রহমান বলেন, অনেক দিন পরে আকাঙ্ক্ষিত এই সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান বেশ ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন। স্বল্প স্বল্প কথায় তিনি উত্তর দিয়েছেন। কোনো বক্তব্যকেই খুব দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করেননি। কোনো বক্তব্য দিয়ে তিনি বিতর্কে জড়াতে চাননি। সাফারিংসের কথা বলেছেন তার পরিবারের, ভাইয়ের, মায়ের, নিজের এবং যৌক্তিকভাবেই সেগুলো বলেছেন। বহু বছর পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। অনেকেই বলতেন, তারেক রহমান কেন কথা বলেন না। তিনি তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন—তিনি নিয়মিত কথা বলেন, জনগণের সঙ্গে, দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে।
জিল্লুর রহমান আরো বলেন, গণমাধ্যমে তারেক রহমান এত দিন কথা বলেননি, যেহেতু তার কথা বলার ওপরে শেখ হাসিনার শাসনামলে আদালত কর্তৃক একটা নিষেধাজ্ঞা ছিল যে তার বক্তব্য প্রচার করা যাবে না, বিবৃতি প্রচার করা যাবে না। সংগতভাবেই তিনি সাক্ষাৎকার দিলে কেউ প্রচার করতে পারতেন না। দু-একটি গণমাধ্যম তার বক্তব্য প্রচার করে বিপদেও পড়েছে। গোটা দেশের মানুষ যে ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে কাটিয়েছেন, সেটা তিনি বর্ণনা করেছেন। তিনি প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি অপরাধের শাস্তি চান। আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রশ্নে তিনি অত্যন্ত স্মার্টভাবে উত্তর দিয়ে বলেছেন, সিদ্ধান্তটা আসলে জনগণ নেবে।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল বলেন, ‘এই সাক্ষাৎকারে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে, যা শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং দার্শনিক ও নৈতিক প্রশ্নেরও জন্ম দেয়। তারেক রহমান বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন কিন্তু সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল তার মন্তব্য—এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন দেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ। তার এই বক্তব্য অসাধারণ। কারণ তিনি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন যে আন্দোলনের পেছনে কোনো একক নেতা নয়, জনগণই ছিল মূল চালিকা শক্তি। ডাকসুর রাজনীতি প্রসঙ্গে তারেক রহমানের বক্তব্য সম্পর্কে মাসুদ কামাল বলেন, ‘তিনি বলেছেন, ডাকসুর নির্বাচনের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে না। আমি তার সঙ্গে একমত।’
তবে মাসুদ কামাল যোগ করেন, ইতিহাসে কিছু ব্যতিক্রম থেকেছে—যেমন আমান-খোকনের ডাকসুর বিজয় ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছিল। তখন তরুণ ভোটাররাই বিএনপিকে জিতিয়েছিল এবং ২০০১ সালেও তাদের ভোট বিএনপির পক্ষে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে তারেক রহমানের বক্তব্যকে মাসুদ কামাল আখ্যা দেন ‘অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার, পরিমিত ও সংযত' হিসেবে।
মাসুদ কামাল বলেন, তারেক রহমান নিজের ১৭ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস এমনভাবে বর্ণনা করেছেন, যা হৃদয় স্পর্শ করে। মা, ভাই, পরিবার, স্মৃতি—সবকিছুর ওপর দিয়ে যে নির্যাতন গেছে, তা তিনি সংযমী ভাষায় বলেছেন। তার বক্তব্যে কোনো ক্রোধ নেই, আছে মমতা ও পরিমিতি বোধ। তার বক্তব্যে শুনে আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি ব্যক্তিগত প্রতিশোধের কথা বলেননি। বলেছেন, সমস্ত অপরাধের বিচার হতে হবে, তবে এটি প্রতিশোধের নয়, এটি ন্যায়ের প্রশ্ন। রাষ্ট্রনায়কসুলভ বক্তব্য বলতে যা বোঝায়, এটাই তাই।
মাসুদ কামাল আরো বলেন, ‘তারেক রহমান পরিষ্কার করে দিয়েছেন—আওয়ামী লীগের অন্যায় শুধু জুলাই মাসে সীমাবদ্ধ নয়; গত ১৫ বছর ধরেই তারা যে দুঃশাসন চালিয়েছে, সেটিরও বিচার হতে হবে। এই ১৭ বছরের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি প্রমাণ করেছেন, বিএনপির আন্দোলন হঠাৎ জন্ম নেয়নি বরং দীর্ঘকালীন অন্যায়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে গড়ে উঠেছে।' আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ প্রসঙ্গে তারেক রহমানের অবস্থান সম্পর্কে মাসুদ কামাল বলেন, ‘তিনি অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। বলেছেন—‘যদি দল হিসেবে তারা অন্যায় করে থাকে, তাহলে দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে।’
খবরটি শেয়ার করুন