ছবি : সংগৃহীত
জন্মনিয়ন্ত্রণের একটি কার্যকর পন্থা হিসেবে মানুষ মুখে খাওয়ার জন্মনিরোধক বা ওরাল কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে এখনো একশ বছর হয়নি। গত শতকের ১৯৬০ সালের নয়ই মে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন মুখে খাওয়ার জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির অনুমোদন দেয়। এরপর থেকে গত ৬৪ বছরে নারীর জন্মনিয়ন্ত্রণসহ গাইনি সংক্রান্ত নানা সমস্যার সমাধানে বড় নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ওরাল কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল। তবে এই জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খেলে কি মোটা হয় মানুষ? চলুন জানা যাক এ সম্পর্কে জানা অজানা তথ্য-
আমেরিকাতেই প্রথম জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি হিসেবে মুখে খাওয়ার পিল তৈরি করা হয়েছিল। বার্মিংহাম এবং স্লোতে কয়েকশো বিবাহিত নারী স্বেচ্ছাসেবকের উপর সেই পিলের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়েছিল।
পরের বছর ১৯৬১ সালের অক্টোবরের মধ্যে, ব্রিটিশ পরিবার পরিকল্পনা অ্যাসোসিয়েশন তাদের গর্ভ-নিরোধকের অনুমোদিত তালিকায় পিলটিকে যুক্ত করে, যা একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল। কারণ এই অ্যাসোসিয়েশনই যুক্তরাজ্যে পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদানকারী সংস্থা ছিল।
জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি কী? কীভাবে কাজ করে?
জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি কেবলমাত্র নারীদের জন্যই তৈরি করা হয়। পুরুষদের জন্য এখনো জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি বাজারে আসেনি। জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি এক ধরনের ওষুধ যাতে হরমোন থাকে, যে হরমোন নারীর ডিম্বাশয় থেকে ডিম নিঃসরণে বাধা দিয়ে গর্ভধারণ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
বেশিরভাগ মুখে খাওয়ার গর্ভনিরোধকে এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টিন হরমোন থাকে। এর প্রধান কাজ ওভুলেশন বা ডিম নিঃসরণে বাধা দেয়া, এবং এস্ট্রোজেন মাসিকের রক্তপাত নিয়ন্ত্রণ করা।
চিকিৎসকরা বলেন, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো নিয়মিত জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খেলে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই গর্ভধারণ প্রতিরোধ করা যায়।
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় মুখে খাওয়ার বড়ি। বাজারে কয়েক ধরনের বড়ি পাওয়া যায়। যেমন- কম্বাইন্ড ওরাল পিল, প্রোজেস্টেরন অনলি পিল বা মিনিপিল এবং ইমার্জেন্সি পিল। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত বড়ি বা পিল কম্বাইন্ড পিল, যা এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের মিশ্রণে তৈরি।
তারা বলছেন, প্রথম প্রজন্মের বড়িতে হরমোনের যে উচ্চ মাত্রা ছিল তা এখন স্বল্প মাত্রার হয়েছে। শুধুমাত্র কোনো ব্যতিক্রমী অবস্থা ছাড়া যার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অনেক কম। কম্বাইন্ড পিল সাধারণত ২৮টি ট্যাবলেটের একটি পাতায় পাওয়া যায়। যার মধ্যে ২১টি সক্রিয় পিল থাকে, আর সাতটি নিষ্ক্রিয় আয়রন পিল থাকে।
সাধারণ ক্ষেত্রে মাসিকের প্রথম দিন থেকে পিল খাওয়া শুরু করতে হয় এবং টানা ২১ দিন খেতে হয়। প্রথম দিন খেতে ভুলে গেলে পঞ্চম দিন পর্যন্ত যেকোনো দিন শুরু করা যায়। কেউ একদিন পিল খেতে ভুলে গেলে, পরদিন যখন মনে পড়বে তখনই খেয়ে নেয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
পিল খেলে কি মোটা হয়ে যায়?
চিকিৎসকরা বলছেন, জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি খেলে মেয়েরা মোটা হয়ে যায় এটি সঠিক নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওজন বাড়ে। কিন্তু সেটা শরীরে জলীয় পদার্থ জমে যাওয়ার কারণে বাড়ে। আর পিল খাওয়ার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় এই জলীয় পদার্থ জমে যায়। যা আবার কয়েক মাসের মধ্যে চলেও যায়।
হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক কিশোয়ার লায়লা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “আগে পিল খেলে মোটা হতো এমন ধারণা ছিল। কিন্তু সেটা সঠিক ছিল না। আবার এখন আধুনিক যেসব লাইট পিল পাওয়া যায় সেসব খেলে মোটা হয় এটাও ঠিক না। অর্থাৎ পিলের জন্য মোটা হয় এ তথ্য সঠিক নয়।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক রেজাউল করিম কাজল বলেছেন, শুরুর দিকের পিলগুলোতে যে হরমোন ব্যবহার করা হতো, তাতে ক্ষুধা বাড়তো, শরীরে কিছুটা পানিও জমাতো- তাই ওজন বাড়তো।"কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত পিলগুলো তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের। চতুর্থ প্রজন্মের পিলগুলোতে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে।"
অধ্যাপক কাজল বলেছেন, এগুলো রক্তের কোলেস্টেরলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া মাসিক নিয়মিতকরণসহ নারীদের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার পিল ব্যবহার করা হয়।
আরো পড়ুন : ভিটামিন ডি কমে গেলে বুঝবেন কীভাবে?
মুড সুইং
যে নারীরা জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খান অনেক সময়ই তাদের আচরণ পাশে থাকা মানুষেরা বুঝতে পারেন না। কখন তারা খুশি আর কখন বিষাদ গ্রাস করেছে তাদের- তা অনুমান করা কঠিন।
সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, এ নারীদের মুড সুইং হয়েছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, মস্তিষ্কের ওপরেও জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির প্রভাব রয়েছে।
সর্বশেষ ২০১৯ সালে ‘রেডিওলজি সোসাইটি অফ নর্থ আমেরিকা’র ১০৫তম বার্ষিক সম্মেলনে এ বিষয়ক এক গবেষণা উপস্থাপন করা হয়।
তাতে গবেষকরা দেখান, যারা জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খেয়েছিলেন তাদের মস্তিষ্কের ‘হাইপোথ্যালামাস’ এর ঘনত্ব আর যারা ওষুধ সেবন করছিলেন না তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে।
‘হাইপোথ্যালামাস’ হচ্ছে যৌনক্ষমতা, ঘুমের চক্র, মেজাজ নিয়ন্ত্রণ, খাওয়ার রুচি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রবিন্দু । চিকিৎসকরাও জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবনে নারীদের মুড সুইং হওয়ার প্রবণতার বিষয়টি উল্লেখ করছেন।
অধ্যাপক কিশোয়ার লায়লা বলেছেন, “বর্তমানে যে জেনারেশনের (ধরনের) স্বল্পমাত্রার পিল বাজারে পাওয়া যায়, তাতে মুড সুইং এখন কম হয়। আগে পিলে হরমোনের উচ্চ মাত্রা ছিল এখন পিলের ডোজ অনেক লো (কম)। ফলে মুই সুইং খুব কম হয়।”
পিরিয়ড বা মাসিক সংক্রান্ত জটিলতা
জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি জন্ম নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও অবিবাহিত ও বিবাহিত নারীদের অনিয়মিত মাসিক, মাসিকের সাথে অতিরিক্ত রক্তস্রাব, মাসিকের সময় তলপেটে ব্যথা, মুড সুইংসহ নানা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহারের পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
এছাড়া এনডোমেট্রিওসিস, ডিম্বাশয়ের সাধারণ ছোট খাটো সিস্ট, বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসায় নির্দিষ্ট সময় মাসিক ঘটানো, যে কোনো অপারেশন ও চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সময় পর্যন্ত মাসিক বন্ধ রাখা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে পিল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা। তবে, নিয়মিত পিল ব্যবহারকারীদের মাসিকের সমস্যা হয় এমন ধারণা রয়েছে অনেকের মনে। যদিও চিকিৎসকরা বলছেন, এ ধারণা যথার্থ নয়।
হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক কিশোয়ার লায়লা বলেন, পিরিয়ড বা মাসিকের সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক সময় পিল খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। পিল খাওয়ার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এড়াতে অধ্যাপক কিশোয়ার লায়লার পরামর্শ এ রকম - একটানা জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়া যাবে না। কিছু সময় বিরতি দিয়ে পিল খেতে পরামর্শ দেয়া হয়। হয়তোবা ছয়মাস খাবে এরপর দুই মাস অন্য পদ্ধতি নিবে আবার ছয় মাস খাবে। এভাবে পরামর্শ দেয়া হয়।
সাধারণ পিলের সাথে ইমারজেন্সি পিলের পার্থক্য কী?
সাধারণভাবে চিকিৎসকরা যেসব পিল খাওয়ার পরামর্শ দেন তার সাথে ইমারজেন্সি পিল বা আইপিলের পার্থক্য রয়েছে।
চিকিৎসকরা বলেছেন, ইমার্জেন্সি পিল এস্ট্রোজেন হরমোন নির্ভরশীল পিল। বিভিন্ন সময় বিশেষ পরিস্থিতি যেমন - কনডম ছাড়া যৌনমিলন, কনডম ফেটে যাওয়া, ধর্ষণের শিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে গর্ভধারণ ঠেকাতে ইমারজেন্সি পিল কার্যকর উপায়।
এটি একটি ট্যাবলেট একবার বা ১২ ঘণ্টা অন্তর দুই ডোজে ব্যবহার করতে হয়। পিল অবশ্যই অরক্ষিত যৌন মিলনের পাঁচ দিনের মধ্যে ব্যবহার করতে হয়।
গাইনি চিকিৎসক ডা. উর্মিলা মজুমদার গণমাধ্যমকে জানান, সাধারণ পিলের সাথে ইমারজেন্সি পিলের পার্থক্য হলো - শারীরিক সম্পর্ক হোক বা না হোক কেউ যদি জন্মনিরোধ করতে চায়- তবে সে রেগুলার পিল খাবে।
যখন কেউ জন্মনিরোধক পদ্ধতি নেয়নি, কিন্তু শারীরিক সম্পর্কের ফলে গর্ভধারণের সম্ভাবনা আছে সেক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টার মধ্যেইমারজেন্সি পিল বা আইপিল খেতে পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে।
আরো পড়ুন : ফোন ছাড়া থাকলেই অস্থির লাগে?
সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা কমে যায় ?
নারীদের অনেকের একটি ধারণা রয়েছে- অন্য চিকিৎসার জন্য এটি খেলে তা সন্তান জন্মদানের সক্ষমতায় প্রভাব ফেলে।
চিকিৎসকরা বলছেন, এ ধারণাটি সঠিক নয়। এটি সন্তান জন্মদানের সক্ষমতায় কোনোভাবেই প্রভাব ফেলে না। পিল বন্ধ করার পর হয়তো পিরিয়ড শুরু হতে দেরি হয় কিন্তু ফার্টিলিটি বা প্রজনন সক্ষমতা আবার ফিরে আসে।
তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা নারীদের জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়া থেকে বিরত থাকা বা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দেন।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবনে নিরুৎসাহিত বা সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।
যেমন - ৪০ বছরের বেশি বয়স হলে, যোনিপথের রক্তক্ষরণ, রক্তে অধিক কোলেস্টেরলের মাত্রা রয়েছে এমন সব ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়ার বিষয়ে বাধা রয়েছে।
এছাড়া, রক্তনালির বা রক্ত জমাট বাঁধাজনিত রোগে আক্রান্ত, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস, ব্রেস্ট ক্যানসার, লিভারের রোগ, জন্ডিস বা ক্যানসার, আগে স্ট্রোক হয়েছে বা হার্টের রোগ আছে তাদের জন্যও বাড়তি সতর্কতা নিতে হবে।
আর বড় কোনো অপারেশনের আগে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে নারীদের পিল খাওয়া শুরু বা বন্ধ রাখার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন চিকিৎসকরা।
এস/ আই.কে.জে/