ফাইল ছবি
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রমাণ ও সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়াই হত্যা মামলা দেওয়া, তাদের অ্যাক্রিডেশন কার্ড বাতিল করা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'তাড়াহুড়ো করে কাজ করলে যা হয়। এটা আমরা থামিয়েছি। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করতে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। এই কমিটি রিভিউ করে দেখবে যে এসব মামলার কোনো ভিত্তি আছে কি না। তাদের সুপারিশের পরে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
২০২৪ সালের নভেম্বরে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। এর আগে একই বছরের ১১ই সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মন্তব্য করেন, 'সংবাদমাধ্যম ও মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ইতোমধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা সবাইকে বলে দিয়েছি, মন খুলে আমাদের সমালোচনা করেন। আমরা সবার মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। গণমাধ্যম যাতে কোনো রকম বাধা বিপত্তি ছাড়া নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারে, সেজন্য একটি মিডিয়া কমিশন গঠন করা সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন।'
প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্যান্য উপদেষ্টা ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের এ ধরনের বক্তব্যের প্রতিফলন বাস্তবে কতোটা ঘটছে, বর্তমান সরকারের শুরু থেকেই বিষয়টি সাংবাদিকদের সামনে বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আনিস আলমগীর সাম্প্রতিক সময়ে টেলিভিশন টকশো ও সামাজিক মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনা করে আলোচনায় এসেছিলেন। সবশেষ তাকে গ্রেপ্তার করায় প্রশ্ন উঠছে, 'সরকারের সমালোচনা' গ্রহণ করা হবে না, এমন বার্তাই এই গ্রেপ্তারের মাধ্যমে দেওয়া হল কিনা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলার যে অভিযোগ উঠেছিল, এখন আবার সেই ভয়ের সংস্কৃতিই ফিরে এসেছে কিনা, সেই প্রশ্নও উঠছে। এ গ্রেপ্তারকে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, 'ভিন্নমত দমনের একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত'।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের মিলিয়ে অন্তত ২৯৭ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যা চেষ্টা ও গোলাগুলির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা দায়ের হয়েছে। সবশেষ আনিস আলমগীরসহ ১৯ জন সাংবাদিক এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন; মঞ্জুরুল আলম পান্না, গাজী টিভির ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রতিনিধি জহির রায়হানসহ কয়েকজন জামিন পেয়েছেন। বাকিরা আছেন কারাগারে, থেমে নেই সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারের ঘটনা।
বেশিরভাগ মামলার বিচারিক কার্যক্রম ঠিকমতো পরিচালিত হচ্ছে না বলে অভিযোগ সাংবাদিক সমাজের। অভিজ্ঞ সাংবাদিকেরা বলছেন, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এমন ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে—যার অনেকগুলোই হত্যার অভিযোগে—যেসব মামলায় তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তদন্তই হয়নি, কিংবা আজ পর্যন্ত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
অনেক সাংবাদিক দীর্ঘদিন ধরে প্রমাণ ছাড়া আটক রয়েছেন। এ ধরনের আটক ও জামিন না পাওয়ায় বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও সরকারের সংস্কার প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পুলিশ মামলা নেওয়ার বা গ্রেপ্তারের আগে কোনো ধরনের তদন্তের চেষ্টা পর্যন্ত করেনি। পুলিশ ১৬ মাসের মধ্যেও আদালতে এমন কোনো নতুন প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি, যা এ নির্দিষ্ট অভিযোগগুলোর সঙ্গে সাংবাদিকদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে।
জুলাই অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিভিন্ন হত্যা মামলায় সাংবাদিকদের আসামি করা হয়। এসব মামলা পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ‘গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণ–সংক্রান্ত কমিটি’ গঠন করে সরকার।
হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণে সরকারের গঠিত আট সদস্যের কমিটির আসল দায়িত্ব কী, বিষয়টি অনেক সাংবাদিকের কাছে স্পষ্ট নয়। কমিটির কোনো কাজও তাদের কাছে সেভাবে দৃশ্যমান নয়। এই কমিটি গঠনের পর প্রায় ১৫ মাস পার হয়ে গেলেও এর মাধ্যমে মামলার শিকার ও কারাবন্দী সাংবাদিকদের উপকৃত হওয়ার তথ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিকদের হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানে রয়েছে। মামলার শিকার কোনো কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গত সরকারের আমলে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নেওয়া ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হওয়া নিয়ে শুরু থেকেই নানা প্রশ্ন আছে।
পর্যবেক্ষণ কমিটির আসল কাজ কি
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রায় দেড় বছর পর হত্যা ও সহিংসতার মামলার বেড়াজালে জড়িয়ে আছে অন্তত ২৯৭ জন সাংবাদিকের নাম। অথচ সরকারের কমিটি প্রায় দেড় বছরে পেয়েছে মাত্র ৭২ জন সাংবাদিকের নাম। অনেক সাংবাদিক হয়রানিমূলক মামলার শিকার হলেও কমিটি তাদের খবর পায়নি। এই কমিটির পাঠানো ৭২ জনের তালিকাও আটকে আছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
সরকারের কমিটির দায়িত্ব হবে গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণ করা ও সময়ে সময়ে মামলার বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা, এমন আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে কমিটি গঠিত হয়। ২০২৪ সালের ৭ই অক্টোবর তথ্য মন্ত্রণালয় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া হয়রানিমূলক মামলার পুনর্মূল্যায়নের জন্য এ কমিটি গঠন করে। এরপর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ১লা জুলাইয়ের পর দায়ের হওয়া মামলার বিস্তারিত ও প্রমাণাদি জমা দিতে বলা হয়, ব্যক্তিগতভাবে বা সম্পাদকদের মাধ্যমে।
ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম এসব প্রসঙ্গে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার আমাদের অপমান করছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সাংবাদিকদের ওপর সবচেয়ে বড় বিচারিক হয়রানি হতে দিয়ে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই ১৯ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও লজ্জাজনক বাস্তবতা হলো, অন্তত ২৯৭ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে—যার অনেকগুলোই হত্যার অভিযোগে—যেসব মামলায় তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তদন্তই হয়নি, কিংবা আজ অব্দি কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, গত বছর তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণে কমিটি গঠন করেছিল সরকার। চলতি বছরের ২৮শে সেপ্টেম্বর এক বৈঠকে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, আমরা ৭২ জন সাংবাদিকের নাম পেয়েছি। আমাদের মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার না থাকায় তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি তদন্তের জন্য। তার মানে, সেখানেই বিষয়টি আটকে আছে। কমিটি গঠনের পর এতগুলো মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
ডিজিএফআইয়ের হুমকি নেই
সাংবাদিক জ. ই. মামুন ও আশিস সৈকত তখন বেসরকারি দুটি টিভি চ্যানেল যথাক্রমে এটিএন বাংলা এবং ইনডিপেনডেন্টের শীর্ষ দায়িত্বে। ২০১৮ সালের ১১ই জানুয়ারি ঢাকার পিআইবির মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দু'জনই আমন্ত্রিত আলোচক ছিলেন। এতে এটিএন বাংলার তখনের প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ. ই. মামুন বলেন, ‘গণমাধ্যমের ওপর মালিক, বিজ্ঞাপনপক্ষ ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার চাপ আছে। এসব কারণে দেশে জনমুখী সাংবাদিকতা হচ্ছে না। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো সংবাদ ছাপা হবে কী হবে না, তা নিয়ে চাপ দেওয়া হচ্ছে।’
ইনডিপেনডেন্ট টিভির ওই সময়ের প্রধান বার্তা সম্পাদক আশিস সৈকত বলেন, 'বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের পরও দেশের কয়েকজন সম্পাদককে একটি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে ডেকে নেওয়া হয়েছে। ওই সংবাদের একটি প্রতিবাদলিপি ধরিয়ে দিয়ে সাংবাদিকদের কোনো মন্তব্য ছাড়াই তা প্রকাশ করতে বাধ্য করা হয়েছে।' ঠিক কতজন সম্পাদককে ওই সময় গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ডেকে নিয়ে কথিত প্রতিবাদলিপি ধরিয়ে দেন, এর সঠিক সংখ্যা আশিষ সৈকত অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে উল্লেখ করেননি।
সুখবর ডটকমের অনুসন্ধান বলছে, জাতীয় চারটি দৈনিক পত্রিকার চারজন সম্পাদককে ডিজিএফআই তখন ডেকে নেয়। যে সংবাদের ভিত্তিতে তাদের ডেকে নেওয়া হয় ডিজিএফআইয়ের কার্যালয়ে, তা ছিল আওয়ামী লীগের সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রতিবেদন।পিআইবিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জ. ই. মামুন ও আশিস সৈকতের বক্তব্যে সেই সময়ের সাংবাদিকতায় গোয়েন্দা সংস্থার চাপ, মালিকপক্ষের হস্তক্ষেপের পাশাপাশি অনেক সাংবাদিকের 'জনমুখী ও মুক্ত সাংবাদিকতার' দাবি বর্ণিত হয়েছে।
ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ-এর সম্পাদক নূরুল কবীর বলছেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আওয়ামী লীগের স্বৈরতান্ত্রিক জমানার তুলনায় সাধারণভাবে অবশ্যই সম্প্রসারিত হয়েছে। পত্রিকার সম্পাদকদের এখন আর আওয়ামী জমানার মতো বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সাংবাদিকতা সম্পর্কে নসিহতমূলক বার্তা গ্রহণ করতে হয় না।'
ড. ইউনূসের সরকারের শুরু থেকে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকেরা ডিজিএফআইয়ের কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকি মুক্ত। তাহলে প্রশ্ন আসে, ২০২৪ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের জন্য ভয়মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত হচ্ছে না কেন? দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, 'এসব ঘটনা আমাকে আতঙ্কিত করছে। কেন জানি মনে হয়, আগের পরিস্থিতির দিকেই যাচ্ছি আমরা। আমার মনে হয়, সরকারপ্রধান দৃষ্টি না দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।'
নীতিমালা নির্ধারণ কী সাংবাদিকেরা করেন
বিএনপি-জামায়াতের সমর্থিত ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা, জাতীয় প্রেসক্লাবের শীর্ষ দায়িত্ব পালনকারী এক সাংবাদিকসহ অনেক সাংবাদিক এখন কাজ করছেন ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের মালিকানাধীন দৈনিক কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ডেইলি সান, বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর, নিউজ টোয়েন্টিফোর চ্যানেল, টি-স্পোর্টস ও ক্যাপিটাল এফএম রেডিওতে। গত কয়েক ধরে হঠাৎ করে ইস্ট ওয়েস্ট গ্রুপের প্রচারমাধ্যমগুলো 'অতি সরকারবিরোধী'।
এসব প্রচারমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, উপদেষ্টা পরিষদের কোনো না কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনামূলক একাধিক বিশেষ লেখা, কলাম ও মন্তব্য প্রতিবেদন থাকে। ওই সংবাদমাধ্যমগুলোতে কর্মরত বিএনপি-জামায়াতের প্রতি 'সহানুভূতিশীল' অন্তত চারজন সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুখবরকে বলেন, 'পেশাদারত্বের জায়গা থেকে তারা সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করতে চান। তবে ইস্ট ওয়েস্ট গ্রুপের আকস্মিক অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার নীতিমালা নির্ধারণে সাংবাদিকদের কোনো ভূমিকা নেই। এ বিষয়ে মালিকপক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।'
বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো, যেখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণমাধ্যমগুলো প্রতিষ্ঠা পায়নি, সেসব দেশে গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতিমালা নির্ধারণে সাংবাদিকদের ভূমিকা রাখার সুযোগ সাধারণত থাকে না। মালিকের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশই সাংবাদিকদের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে 'চূড়ান্ত স্বাধীনতা'।
আওয়ামী লীগের আমলে শীর্ষ দায়িত্বে থাকা অনেক সাংবাদিক চাইলেও যেমন মালিকপক্ষসহ নানা চাপে স্বাধীন সাংবাদিকতা সবসময় করতে পারেননি, বর্তমানেও তা অনেকে করতে পারছেন না ঘুরেফিরে প্রায় একই কারণে। মালিকপক্ষের চাপে গত বছরের ৫ই আগস্টের পর থেকে আগের নীতিমালা বিসর্জন দিয়ে সাংবাদিকতার নামে যাচ্ছেতাই ছাপছে দৈনিক জনকণ্ঠ, যুগান্তরের মতো পত্রিকাগুলো।
ভারতীয় এক লোকসভা নির্বাচন, ওই নির্বাচনেই নরেন্দ্র মোদি প্রথম দেশটির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হন। ভারতের প্রভাবশালী একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার মালিকের নির্দেশ ছিল- বিজেপির নেতৃত্বের জোটের নির্বাচনী প্রচারণার খবর মোদির ছবিসহ তার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপাতে। দেশটির সাংবাদিক সিদ্ধার্থ ভরদরাজন তখন ওই পত্রিকার শীর্ষ পদের দায়িত্বে।
তার যুক্তি ছিল- মোদির মতো উগ্র গেরুয়াবাদী রাজনীতিকের ছবি প্রগতিশীল নীতিমালায় বিশ্বাসী কোনো পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানো যায় না। মালিকের নির্দেশ মতে মোদির ছবি ঠিকই পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয় আর চাকরি ছাড়তে হয় সিদ্ধার্থকে।
বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোতে সাংবাদিকদের জন্য যেখানে এমন বাস্তবতা বিদ্যমান, সেখানে ২০২৪ সালের ৫ই আগস্টের পর আওয়ামী লীগের প্রতি 'সহানুভূতিশীল' সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে 'ফ্যাসিস্টের সহযোগী' অ্যাখ্যা দিয়ে চাকরিচ্যুত করা, তাদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণহীন 'হত্যা মামলা' দায়ের করার ঘটনাগুলো শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। এ রকম ভিত্তিহীন মামলায় কয়েকজন সাংবাদিককে মাসের পর মাস ধরে সরকার কারাবন্দী করে রেখেছে।
প্রমাণ ছাড়া এতো সাংবাদিককে কারাবন্দী করে রাখার বিষয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার ইতিমধ্যে 'বিশ্বরেকর্ড' গড়েছে। এ রকম উদাহরণ কোনো দেশের গণতান্ত্রিক, এমনকি অগণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও বিরল।
দৈনিক প্রথম আলো মনে করছে, 'ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের সময় সহিংসতার অভিযোগে আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে পরিচিত অনেকে (সাংবাদিক) দীর্ঘদিন ধরে প্রমাণ ছাড়া আটক রয়েছেন। এ ধরনের আটক ও জামিন না পাওয়ায় বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও সরকারের সংস্কার প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।'
সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বহু বছর ধরে আইসিটির বিচার কার্যক্রম ও বাংলাদেশ নিয়ে লিখছেন। তিনি বলছেন, 'গ্রেপ্তার ও মামলা হওয়া কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ অবশ্যই থাকতে পারে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে তারা এমন এক সরকারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যে সরকার বিরোধী দল দমন করেছে, নির্বাচনে জালিয়াতি করেছে, গুম করেছে, সংবাদমাধ্যমকে চুপ করিয়ে রেখেছে ও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অন্যায়ভাবে মানুষকে আটক রেখেছে। তবু রাজনৈতিক আনুগত্য কিংবা কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসনের কট্টর সমর্থক বা প্রচারক হওয়াটাই অপরাধ নয়।'
খবরটি শেয়ার করুন