শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্যাকেটজাত পণ্যে প্রতারণা

উপ-সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০৩:১৫ অপরাহ্ন, ৩০শে জানুয়ারী ২০২৪

#

অজিত কুমার মহলদার
আমরা কথায় কথায় বলি প্যাকেট। প্যাকেজ শব্দটি কম বলা হয়। খেয়াল করুন, আমরা যেকোনো দোকানো গিয়ে নিজের অজান্তে দ্রব্য কেনার সময় প্যাকেট শব্দটি উচ্চারণ করি। মোড়কজাত পণ্যের বিষয়ে প্যাকেজ শব্দটি বাংলাদেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্যাকেজ একটি ডাচ শব্দ। এটি ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উৎপত্তি হয়েছে। এরপর এটি ইংরেজি ভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে। এখন বাংলার মতো হয়ে গেছে। প্যাকেজ বা প্যাকেট ইংরেজি শব্দ মনে হচ্ছে না এখন। 

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত কিছু নাটককে- প্যাকেজ নাটক বলা হত। একটি নাটকেই সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস ছিল। সাম্প্রতিককালে অনলাইনে পণ্য কেনাবেচায় প্যাকেজ শব্দটি বহুল প্রচারিত। পণ্য যেনতেন, কিন্তু মোড়ক চটকদার, বিজ্ঞাপন চোখ ধাঁধানো। মোড়কের অভ্যন্তরে কাঙ্খিত পণ্য পাওয়া যায় না। বিশেষ করে, চানাচুর, চিপস ও মোটর শুঁটি জাতীয় পণ্যের প্যাকেটে বাতাসই বেশি থাকে। 
মোড়ক, একটি বাংলা কৃৎ প্রত্যয় সাধিত শব্দ। মোড়ক শব্দের প্রকৃতি ও প্রত্যয় হলো মুড়্+অক। সহজে বহনযোগ্য কোনো ঠোঙা, থলি বা প্যাকেটকে মোড়ক বলে। মোড়কের সমার্থক শব্দ হচ্ছে বোঁচকা, আবরক, ঠোঙা, থলি, পুঁটলি, পুরিয়া, খাম ও পুলিন্দা। সহজে কোনো পণ্যসামগ্রী বহন করার কাজে মোড়ক ব্যবহৃত হয়। মোড়ক বস্তু বা পণ্যের আচ্ছাদনী। 

সামাজিক উপন্যাস যোগাযোগ-এ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিব্যক্তি, কুমু (কুমুদিনী) হাত সরাতে চায় না। ওর হাত দিয়ে চাপা আছে একটা কাগজের মোড়ক। মধুসূদন জিজ্ঞাসা করলে, “ঐ কাগজে কী মোড়া?” “জানি নে।’ “জান না, তার মানে কী?” ‘তার মানে আমি জানি নে।” মধুসূদন কথাটা বিশ্বাস করলে না; বললে,“আমাকে দাও, আমি দেখি।” কুমু বললে, “ও আমার গোপন জিনিস, দেখাতে পারব না।” 

আমরা যখন দেশের কোনো পণ্যের মোড়ক খুলে দেখতে যাই, তখনই অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকতে হয়। বায়ুর অনুভূতি নিতে হয়। কারণ প্যাকেটে বাতাস ভরেই বিক্রি করা হচ্ছে পণ্য। চর্ম চক্ষু দিয়ে শান্তিমতো দেখার কিছু থাকে না। যা দেখি তাতে শান্তি পাই না। প্রশান্তি আসে না। তৃপ্তি হয় না মন। চর্ম চক্ষু দিয়ে দেখা যায় না পূর্ণ মাত্রার আশানুরূপ পণ্য। বাজারে রঙচটা মোড়কে পণ্য দেখা যায় বেশি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, প্যাকেটের অভ্যন্তরে পণ্য বা বস্তুর তুলনায় বায়ু থাকে বেশি। পণ্যের চেয়ে মোড়কই বড়। ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করেই চলেছে বিভিন্ন ব্যবসা শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ক্রেতা বা ভোক্তা যেন প্রতারিত না হন, সেজন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। 

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১৮ সালে ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ড আইন প্রণয়ন করে। এর ৭২, ২৪ (পঠিত) ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ২০২১ সালে শিল্প মন্ত্রণালয় ‘পণ্য মোড়কজাতকরণ বিধিমালা’ প্রণয়ন করে। এতে মোড়ক শব্দটির সংজ্ঞা দেওয়া আছে। এছাড়া কয়েক ধরনের মোড়কের কথাও বলা হয়েছে। ২ বিধির ১৯ উপবিধিতে মোড়ক অর্থ বিক্রয়যোগ্য পণ্যের সঠিক মান রক্ষার্থে পণ্য সংরক্ষণ ও আচ্ছাদন করবার নিমিত্ত ব্যবহৃত কোনো কেস, বাক্স, কার্টুন, প্যাকেট বা স্যাকপ্যাক, পাত্র, আধার, আচ্ছাদনের কাগজ, ভাজ করা কাগজের বাক্স, ভ্যাসেল, কৌটা, বোতল, ক্যান, পুঁটলী, গাঁইট, বোঁচকা, র‌্যাপার, লেবেল, টিকেট, রিল, ফ্রেম, কোন (Cone), ক্যাপসুল, টুপির ন্যায় ঢাকনা, ঢাকনা এবং এই জাতীয় দ্রব্যকে বুঝায়। 

মোড়কের আকার, আকৃতি, রং ও পণ্য সম্পর্কে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন বিষয়ক ২০ বিধিমালায় বলা হয়েছে, পণ্য সম্পর্কে কোনো মিথ্যা বা ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয় বা সত্য নয় এমন কোনো তথ্য বা অভিব্যক্তি কোনো মোড়কে ঘোষণা, প্রকাশ ও প্রদর্শন করা যাবে না। এছাড়া সরকার অনুমোদিত বা স্বীকৃত তথ্য, প্রমাণপত্র ও গবেষণাপত্র না থাকলে কোনো পণ্যকে শতভাগ হালাল, সুপার পিউর, ১০০% খাঁটি, ১০০% পরিশোধিত, রং ফর্সাকারী, রোগনিরাময়কারী, মাথা ঠান্ডাকারী ইত্যাদি বলা যাবে না। গুরুত্ব বাড়াতে পণ্যের পরিমাণ ও পুষ্টিগুণের মিথ্যা তথ্য বা অপকৌশল অবলম্বন করা যাবে না। এছাড়া পণ্যের নিট ওজন, পরিমাণ বা সংখ্যা বুঝাতে মোড়কের গায়ে রাজা, রাণী, জাম্বু, জায়ান্ট, ইকনমি, সর্বনিম্ন, সর্বমোট, আনুমানিক, ডজন, পোন, কুড়ি শব্দ ব্যবহার করা যাবে না।  

বিধিমালার তৃতীয় অনুচ্ছেদের ২০ (৪চ)তে আরও বলা হয়েছে, কোনো মোড়কের আকার বা আকৃতি কোনোক্রমেই মোড়কের অভ্যন্তরস্থ পণ্যের পরিমাণ অপেক্ষা দ্বিগুণের বেশি হতে পারবে না।
খুচরা বিক্রয় এবং সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয়মূল্য। কোনো পণ্যসামগ্রী খুচরা বিক্রয়কারী এজেন্সির মাধ্যমে বা অন্য কোনো মাধ্যমে স্বতন্ত্র ব্যবহারকারীর নিকট বা অন্য যেকোনো ভোক্তার নিকট বিক্রয় করাকে খুচরা বিক্রয় বলে। অন্যদিকে যে সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয়মূল্যে মোড়কজাত পণ্য ভোক্তা সাধারণের কাছে বিক্রয় করা হয়, তাই এমআরপি। 

‘খুচরা মোড়ক’ খুচরা বিক্রয়কারী এজেন্সির মাধ্যমে বা অন্য কোনো মাধ্যমে স্বতন্ত্র ব্যবহারকারীর নিকট বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে উৎপাদন, বিতরণ, সরবরাহ, প্রদর্শন বা জমা করা হয় এমন পণ্যসামগ্রীর মোড়ক।
‘পাইকারী মোড়ক’ অর্থ এমন মোড়ক যা একাধিক খুচরা মোড়কজাত পণ্য ধারণ করে; বিক্রয়, বিতরণের উদ্দেশ্যে উৎপাদন, প্রদর্শন বা জমা করা হয়।  

ব্র্যান্ড অর্থ একটি নাম। পরিচিতিজ্ঞাপক শব্দগুচ্ছ। এটা থাকা বাধ্যতামূলক। যেমন কোকাকোলা, নিশান, স্কয়ার, টয়োটা। ব্যাচ, তারিখ থাকতে হবে। বারকোড বা রেখা সংকেত থাকতে হবে, যাতে করে যন্ত্র ও ইন্টারনেট দিয়ে পণ্যের বিস্তারিত তথ্য দ্রুত পাওয়া যায়। 

মোড়কের গায়ে পণ্যের নিট ওজন ও পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে। নিট পরিমাণ- মোড়কের অভ্যন্তরে ঘোষিত বস্তু বা পণ্যের ওজন আকার, পরিমাণ, সংখ্যা মোড়কের বাইরে উল্লেখ করতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট বস্তু বা পণ্যের ক্ষেত্রে মোড়ক ও মোড়কজাতকরণের বস্তু ব্যতীত শুধু পণ্যের ওজন, পরিমাণ বা সংখ্যা, সাইজ বা আকারকে বুঝাবে। 

উৎপাদনকারী, মোড়কজাতকারী, বিপণনকারী বা বাজারজাতকারীর নাম এবং কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ ঠিকানা থাকতে হবে। আমদানিকারকের পূর্ণ নাম-ঠিকানাও পণ্যের মোড়কে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে। মোড়ক যথাযথ না হলে পণ্য বাজেয়াপ্ত করা যাবে। মোড়কে অতিরঞ্জন হবে না।  প্রচলিত আছে ‘চেনা বামনের পৈতা লাগে না’। তাই প্রকৃত গুণমান ও পুষ্টিগুণ অটুট থাকলে সঠিক পণ্য চিনতে ক্রেতার কষ্ট হয় না। উৎপাদনকারীকে গুণগতমান ঠিক রেখে পণ্য উৎপাদনে ও পণ্য মোড়কীকরণে বাধ্য করবে সরকার। এজন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে সুশীল সমাজ।  

যে কোনো ধরনের সাবান, ডাল, চাল, আটা, ময়দা, সুজি, লবণ, মটর শুটি, রং, সিমেন্ট, সাবানবিহীন ডিটারজেন্ট-পাউডার, নারিকেল তেল, মধু, কেচাপ, জ্যাম, তরল দুধ, কনডেন্সড মিল্ক, মিনারেল বা ড্রিংকিং ওয়াটার, সোনা, রূপা, পিতল, শেভিং ক্রিম, চিনি, গুড়, দই, রস মালাই, মাঠা, সকল প্রকার সার; মাছ, পশু ও হাঁস-মুরগীর খাদ্য, চোলাই মদ, গুঁড়ো দুধ, কফি, শিশু খাদ্য, পাউরুটি ও কেক, ঘি, হরেক রকমের বেভারেজ, সেমাই, নুডলস্, কাটাতার, তৈরি পোশাক, পেরেক, টায়ার-টিউব, সূতা, থানকাপড়, মোবাইল সেট ও কম্পিউটারসহ যাবতীয় পণ্যে আচ্ছাদন দিতে হবে। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ওজন-পরিমাপের ক্ষেত্রে মোড়কের উপরে সেন্টিমিটার, মিলিমিটার, মিটার, ঘনমিটার, কেজি, গ্রাম, মিলিগ্রাম, মেট্রিক টন, কুইন্টাল, লিটার ইত্যাদি উল্লেখ করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)-এর পরিচালক, পরিদর্শক বা মেট্রোলজি দণ্ড প্রদান করতে পারেন। ভ্রাম্যমাণ আদালতও দণ্ড দিতে পারে।

কয়েকটি পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি, মরিচ, ডাল, ময়দা, তুষ-খুদ-কুড়া, পোল্ট্রি ফিড, ফিস ফিড ও সিমেন্টের মোড়কে পাটের সোনালী আঁশ ব্যবহার করতে হবে। এতে এইসব পণ্যের গুণগত মান ঠিক থাকবে। কিন্তু এর বরখেলাপ হতে দেখা যায়। আমরা মনে করি জলবায়ু ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার আরও প্রসারিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। পণ্যের প্রতি ভোক্তার আকর্ষণ বাড়াতে গিয়ে প্ল্যাস্টিকের আবরণ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। 

বিএসটিআইয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অটুট থাকা জরুরি। পণ্য ও সেবার মান প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং পণ্যের সঠিক ওজন ও পরিমাপ নিশ্চিত করে সংস্থাটি। পণ্যকে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক মানদণ্ডে উন্নীত করে। ভোক্তা ও অংশীজনের স্বার্থ রক্ষা করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সহায়তা প্রদান করাই বিএসটিআইয়ের মিশন-ভিশন।

ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন করে সরকার। এই বছরের ২৪ জুন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর যাত্রা শুরু করে। ২০১০ থেকে ’২৩ সাল পর্যন্ত পয়ষট্টি হাজার ৫০৪টি বাজার অভিযান/তদারকি কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। মোট এক লাখ তেষট্টি হাজার ২৩৯ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা-দণ্ড প্রদান করা হয়েছে। 

ভোক্তা আইনে বলা আছে, মোড়কের বিষয়ে কোনো ত্রুটি ধরা পড়লে কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা সর্বাধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করতে পারে। বা উভয় দণ্ড দিতে পারে। এছাড়া অন্যান্য অপরাধে নানা রকম দণ্ড-জরিমানার বিধান আছে। 

ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ড আইনের ১৬(২খ) ধারায় বলা হচ্ছে, ধারণপাত্র বা মোড়কে উল্লেখিত সমপরিমাণ পণ্য পাওয়া না গেলে বস্তু বাজেয়াপ্ত করতে পারেন ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা পরিদর্শক। আমরা মনে করি ভোক্তা অধিকার বিরোধী সকল কার্যক্রম প্রতিহত করবে সরকার।

অজিত কুমার মহলদার, প্রাক্তন নির্বাহী সদস্য; ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন
azit.mohaldar@gmail.com

প্যাকেটজাত পণ্যে প্রতারণা

খবরটি শেয়ার করুন