সোমবার, ৮ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শর্ত মানলে কারাভোগ থেকে অব্যাহতি পাবেন তিথি

নিউজ ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০১:৪৮ অপরাহ্ন, ১৪ই মে ২০২৪

#

ছবি: সংগৃহীত

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তিথি সরকার। ২০২০ সালে হঠাৎ অভিযোগ ওঠে, তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে আপত্তিকর বা বিরূপ মন্তব্য করে আসছিলেন। এরপরই তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলেন জবির ছাত্র সংগঠনগুলো ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা এই শিক্ষার্থীর বহিষ্কার দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। 

এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০২০ সালে ২৩শে অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তিথি সরকারকে সাময়িক বহিষ্কার করে। এরপরই পরিবার থেকে জানানো হয় তিথি নিখোঁজ। এই বিষয়ে ২৭শে অক্টোবর পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার বোন স্মৃতি সরকার।

তখন তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে মর্মে ২৩শে অক্টোবর তিথি নিজেই পল্লবী থানায় একটি জিডি করেন। জিডির পর পুলিশ তাকে থানায় যেতে বলেন। থানায় যাওয়ার কথা বলে ২৫শে অক্টোবর বাসা থেকে বের হয়ে তিথি আর ফেরেননি। তবে পুলিশ তখন দাবি করে, তিথি পল্লবী থানায় যাননি। পরবর্তী সময়ে সিআইডি জানায়, তিথি নিজেই নিখোঁজের নাটক সাজিয়েছেন।

এরই মধ্যে ২০২০ সালে ২রা নভেম্বর ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে রাজধানীর পল্টন থানায় তিথির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। তিথির আইনজীবী প্রবেশন চেয়ে আবেদন করলে আদালত এক বছরের জন্য কিছু শর্তে তাকে প্রবেশনে মুক্তির আদেশ দেন। এই এক বছরে তাকে শর্তসমূহ মেনে চলতে হবে। শর্ত মানলে আদালত বিবেচনা করবেন তাকে আর সাজা খাটতে হবে কি না। আর শর্ত না মানলে তাকে সাজা খাটতে হবে। 

সেই মামলায় সোমবার (১৩ই মে) রায় ঘোষণা করেন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল। রায়ে বিচারক জুলফিকার হায়াত জবির সাময়িক বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী তিথি সরকারের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। একই সঙ্গে তাকে এক বছরের জন্য প্রবেশনে পাঠানো হয়েছে। তবে এরই মধ্যে এই মামলায় আসামি ২১ মাস কারাভোগ করেছেন। রায়ে বিচারক উল্লেখ করেছেন, পাঁচ বছরের সাজা থেকে আসামির ২১ মাসের কারাভোগের সময় বাদ যাবে। অর্থাৎ এই ২১ মাস সময়কে পাঁচ বছরের সাজার আওতায় ধরা হবে।

আরো পড়ুন: ধর্ম নিয়ে কটূক্তি, জবি শিক্ষার্থীর ৫ বছর কারাদণ্ড

তিথি সরকার কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গড়ে ওঠা বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের জবি শাখার দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ওঠার পর ওই সংগঠন থেকেও তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ওই মামলায় ২০২০ সালের ১১ই নভেম্বর বিকেলে নরসিংদীর মাধবদীর পাঁচদোনায় স্বামী শিপলু মল্লিকের এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ের বাড়ি থেকে তিথি সরকারকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে ওইদিনই রাজধানীর কাপ্তানবাজার এলাকা থেকে তিথির স্বামী শিপলু গ্রেফতার হন।

পরদিন ১২ই নভেম্বর দুই আসামিকে আদালতে হাজির করে তিনদিন করে রিমান্ড আবেদন করে মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডি। তিথি ও তার স্বামীর রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন তাদের আইনজীবী। শুনানি শেষে আদালত তিথিকে রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দিলেও শিপলুর রিমান্ড নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। প্রায় দুই বছর কারাভোগের পর ২০২২ সালের ৭ই আগস্ট জামিনে মুক্তি পান তিথি।

এদিকে, রায়ের পর আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তিথিকে সংশোধন হতে এবং তার বয়োবৃদ্ধ বাবার নিয়মিত দেখভাল ও সেবাযত্ন করাসহ আট শর্তে তাকে এক বছরের প্রবেশনে মুক্তি দেন আদালত। এসময়ে তিনি প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে থাকবেন। আদালত জানিয়েছেন, আসামি তিথি প্রবেশনের শর্তসমূহ যথাযথভাবে পূরণ করলে তাকে আর সাজা না-ও খাটতে হতে পারে।

মামলার অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ৩১শে অক্টোবর সিআইডির সাইবার মনিটরিং টিম দেখতে পায়, সিআইডির মালিবাগ কার্যালয়ের চারতলা থেকে তিথি সরকারকে ‘হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে’ বলে একটি মিথ্যা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা হয়। যা তখন ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রকৃতপক্ষে সিআইডিতে এই রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি।

এই ঘটনার তদন্তে নেমে গুজব রটনাকারী নিরঞ্জন বড়াল নামের একজনকে রামপুরার বনশ্রী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। নিরঞ্জনসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২রা নভেম্বর পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করা হয়।

২০২১ সালের ১৯শে মে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি পুলিশের উপ-পরিদর্শক মেহেদী হাসান তাদের দুজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। একই বছরের ৪ঠা নভেম্বর ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আসসামছ জগলুল হোসেন তিথির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। অন্যদিকে তিথি সরকারের স্বামী শিপলু মল্লিককে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন আদালত। বিচারকাজ চলাকালে এই মামলায় ছয়জন আদালতে সাক্ষ্য দেন।

আইন অনুযায়ী, প্রবেশন হলো অপরাধীকে তার প্রাপ্য শাস্তি স্থগিত রেখে এবং কারাগারে না পাঠিয়ে তাকে শুধরানোর সুযোগ দেওয়া। প্রবেশন আইনে প্রথম ও লঘু অপরাধে দণ্ডিত শিশু-কিশোর বা অন্য কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে কারাগারে না পাঠিয়ে আদালতের নির্দেশে শর্তসাপেক্ষে প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে নিজ বাসায় বা পরিবারের সঙ্গে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে সমাজসেবা অধিদপ্তরের একজন প্রবেশন কর্মকর্তা হিসেবে থাকেন।

মূলত প্রবেশন একটি সামাজিক সংশোধনী কার্যক্রম। কোনো অপরাধী যেন ভবিষ্যতে নতুন করে অপরাধকর্মে লিপ্ত না হন এবং আইন মনে চলা ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেন, প্রবেশনের মাধ্যমে আদালত দণ্ডিত ব্যক্তিকে সেই সুযোগ দেন।

তবে প্রবেশনের মেয়াদ শেষে প্রবেশন কর্মকর্তা যদি সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির আচরণ সন্তোষজনক মর্মে প্রতিবেদন দেন, তবে আসামির কারাদণ্ড মওকুফ হবে। আর যদি আসামির আচরণ অসন্তোষজনক মর্মে প্রতিবেদন দেন, তবে প্রবেশন বাতিল ও আদালতের দেওয়া দণ্ড আসামিকে ভোগ করতে হবে।

এই বিষয়ে সাইবার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নজরুল ইসলাম শামীম গণমাধ্যমকে বলেন, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী তিথি সরকারের পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। তিথির আইনজীবী প্রবেশন চেয়ে আবেদন করলে আদালত এক বছরের জন্য কিছু শর্তে তাকে প্রবেশনে মুক্তির আদেশ দেন। এই এক বছরে তাকে শর্তসমূহ মেনে চলতে হবে। শর্ত মানলে আদালত বিবেচনা করবেন তাকে আর সাজা খাটতে হবে কি না। আর শর্ত না মানলে তাকে সাজা খাটতে হবে।

তিথির আইনজীবী বাবুলুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তিথি সরকার নিজের ভুল স্বীকার করে আদালতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য আদালতের কাছে সুযোগ চান। এর আগে তিনি ২১ মাস জেল খেটেছেন। সব কিছু বিবেচনা করে আদালত তাকে সংশোধনের জন্য এক বছরের প্রবেশন দেন। এই এক বছরে যদি তিনি আচরণগত পরিবর্তনসহ শর্তসমূহ মেনে চলেন তাহলে তাকে আর সাজা খাটতে হবে না। আর শর্ত ভঙ্গ হলে পূর্ণ সাজা ভোগ করতে হবে।

ট্রাইব্যুনালের স্টেনোগ্রাফার মোহাম্মদ মামুন সিকদার গণমাধ্যমকে বলেন, প্রবেশনের সময় শেষ হওয়ার পর প্রবেশন কর্মকর্তা আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। ওই প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করবে তিথি সরকার পুরো পাঁচ বছর সাজা খাটবেন নাকি মুক্তি পাবেন। রিপোর্ট ভালো হলে সাজা না খাটলেও চলতে পারে। আবার রিপোর্ট সন্তোষজনক না হলে সাজা খাটতে হবে।

এইচআ/ আই.কে.জে/  

ধর্ম অবমাননা তিথি সরকার

খবরটি শেয়ার করুন