ছবি - সংগৃহীত
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০২১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি এক অভ্যুত্থানে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে। তারপর থেকেই দেশটিতে অস্থিরতা শুরু হয়। সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ধীরে ধীরে গণবিক্ষোভে পরিণত হয়। হাজার হাজার মানুষ নিহত হলে তা রূপ নেয় সশস্ত্র লড়াইয়ে। এরপর সশস্ত্র লড়াইয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো যোগ দেয়।
২০২৩ সালের ২৭শে অক্টোবর তিনটি জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী জোটবদ্ধভাবে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে বড় পরিসরে অভিযান শুরু করে, যা ‘অপারেশন ১০২৭’ নামে বেশি পরিচিত। এ জোটে আরাকান আর্মি ছাড়াও রয়েছে কোকাং অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ও শান রাজ্যের তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)।
আরাকান আর্মি এক বছরের মধ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে রাখাইনের ১৭টি শহরের মধ্যে ১৩টি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে একের পর এক জয়ের মুখ দেখছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডু শহর দখলে নেয়ার ফলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।
আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনের মংডু, বুথিডাং, চিন প্রদেশের পালেতোয়া এই তিনটি শহরেরই নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। পালেতোয়ার সঙ্গে ভারতেরও সীমান্ত রয়েছে। আরাকান আর্মি এখন দক্ষিণ রাখাইনের গাওয়া, তাউনগুপ ও আন শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে জোরদার লড়াই করছে। যেকোনো সময়ে রাখাইনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে আসবে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে একটি স্বাধীন দেশের আত্মপ্রকাশ এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ১৪টি আঞ্চলিক কমান্ড রয়েছে। এসব কমান্ডের অধীনে নির্দিষ্ট একটি অঞ্চলে সামরিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এর আগে গত আগস্টে চীন সীমান্তবর্তী শান রাজ্যের রাজধানী লাশিওতে অবস্থিত উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয় বিদ্রোহীরা। এটি ছিল বিদ্রোহীদের দখলে যাওয়া প্রথম কোনো আঞ্চলিক সেনা কমান্ড। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আঞ্চলিক সেনা সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করেছে রাজ্যটির জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। এর মধ্য দিয়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তীব্র লড়াইয়ে দ্বিতীয় কোনো আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণ হারালো ক্ষমতাসীন জান্তা। বিশ্লেষকরা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ এই সামরিক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণ হারানো জান্তা সরকারের জন্য বড় ধাক্কা। কেননা এটি ছিল রাখাইনে জান্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা সর্বশেষ শক্ত ঘাঁটি।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান ‘ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস’–বলেছে, মিয়ানমারের জান্তা আর আগের মতো ক্ষমতাধর নেই। বিদ্রোহীদের অব্যাহত হামলার মুখে একের পর এক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জান্তা বাহিনী এখন অনেকটা কোণঠাসা। অনেক সেনা পালিয়ে গেছেন। অনেকে নিহত হয়েছেন। জান্তা বাহিনীর সেনাদের মনোবল ভেঙে পড়েছে। তবে সীমান্ত অঞ্চল ও ছোট ছোট শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারালেও রাজধানী নেপিডোসহ বড় বড় শহরগুলো এখনো জান্তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। বলা চলে, এই মুহূর্তে আরাকানের কার্যত সরকারই এখন আরাকান আর্মি। এর ফলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুধু বিলম্বই হবে না বরং দুরূহ হয়ে পড়বে। কারণ রোহিঙ্গাদের অনেকেই আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে জান্তা বাহিনীর হয়ে লড়াই করেছে। এখন আরাকান আর্মি রাখাইন দখল করায় তারা রোহিঙ্গাদের কোনো আশ্রয় দেবে না। বরং আশঙ্কা রয়েছে, আরও রোহিঙ্গা এখানে আশ্রয়ের জন্য চলে আসবে। ইতিমধ্যে অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা চলে এসেছে। তাই বলা চলে রোহিঙ্গা সমস্যা আরও বাড়ছে, কমছে না।
ইতোমধ্যে বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো প্রচার করছে, কক্সবাজার সীমান্তের পাশে যে কোনো মুহূর্তে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা আসতে চলছে। রাখাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেছে ভারত-চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো—এমন সংবাদও এসেছে বিশ্ব মিডিয়ায়। এতে প্রশ্ন উঠেছে, ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের করণীয় কী? বাংলাদেশ কি নতুন সংকটে পড়তে যাচ্ছে? সীমান্তে আরাকান আর্মি, নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আই.কে.জে/