ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের প্রতি দেশের অন্যতম প্রধান বিএনপিসহ সমমনা ছোট কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সন্দেহ বাড়ছে। ২০২৪ সালের ৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের পর আলী রীয়াজ কোনো 'মিশন' নিয়ে, বা বিদেশ থেকে কোনো গোষ্ঠীর 'উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে' দেশে এসেছেন কী না, তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন দলগুলোর নীতিনির্ধারকেরা। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এসব দল বিএনপির জোটসঙ্গী হতে আগ্রহী।
সংস্কার বাস্তবায়ন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের প্রতিক্রিয়া জানানো নিয়ে বিএনপিকে এখন যে পরিকল্পিতভাবে উভয়সংকটের মুখোমুখি করা হয়েছে, এর পেছনে গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে করছে দলগুলো। ড. রীয়াজের কার্যক্রম, গতিবিধি নতুন করে পর্যবেক্ষণে করছে তারা। ঐকমত্য কমিশনের শীর্ষ পদে বসে দেশি-বিদেশি বিএনপি বিরোধী কোনো গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে আলী রীয়াজের যোগসাজশ আছে কী না, এর তত্ত্বতালাশ করছে তারা।
দলগুলো মনে করছে, চব্বিশের অভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পালনের সুবাদে ড. রীয়াজ দেশের রাজনীতির সংকটময় মুহূর্তে অন্যতম কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থেকে বিশেষ বাস্তবতাকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। সেজন্য দলগুলো তার প্রতি প্রথম দিকে একধরনের আস্থা রাখলেও এখন তার দিকে নানা সন্দেহের তীর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের অন্তত চার নেতা সুখবর ডটকমকে বলেন, ঐকমত্য কমিশন বিএনপির সঙ্গে 'প্রহসন' বা 'প্রতারণা' করেছে। কমিশন, অন্তর্বর্তী সরকার ও দুই-তিনটি রাজনৈতিক দল মিলে একটি পক্ষ তৈরি করছে। এর পেছনে দেশি-বিদেশি শক্তির ইশারায় আলী রীয়াজের ভূমিকা আছে কী না, সন্দেহ গাঢ় হচ্ছে। ড. রীয়াজের অতীতের খবর নিয়ে দলগুলো জানতে পারছে, তিনি ছাত্রজীবন থেকেই আওয়ামী লীগ বিরোধী হলেও কোনোভাবেই বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল নন।
তারা বলছেন, নব্বইয়ের দশকের শুরু ও শেষের দিকে ভারতের বিতর্কিত সংগঠনের অর্থায়নে ঢাকা থেকে দুটি দৈনিক পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয় বলে অভিযোগ আছে। ওই দুটি পত্রিকায় কলাম লেখার মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন আলী রীয়াজ। একটি বিশেষ গোষ্ঠী পত্রিকা দুটির মাধ্যমে তাকে নতুন করে পরিচিত করায়। পত্রিকা দুটির সম্পাদকীয় নীতিমালাকে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো সবসময়ই সন্দেহের চোখে দেখে। ছাত্রজীবনে আলী রীয়াজ পর্যায়ক্রমে দুটি বাম সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তাদের মতে, এর মধ্যে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম দেশের রাজনীতিতে রহস্যময়। ঐকমত্য কমিশনে বসে শুরু থেকেই আলী রীয়াজ জামায়াতে ইসলামীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। কমিশনের সুপারিশে জামায়াত ও এনসিপির চাওয়া প্রতিফলিত হয়েছে। তাই বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, ড. রীয়াজকে আমেরিকায় ফিরে যাওয়ার দাবি জোরালো করা হবে। সমমনা ও মিত্র দলগুলোর মাধ্যমে তাকে গ্রেপ্তারের দাবিও জানানো হতে পারে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে।
জানা যায়, বিএনপিসহ কয়েকটি দল আলী রীয়াজের কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে তারা কোনো আপস করবে না। আনুষ্ঠানিকভাবে জোট না হলেও তাই আগামী দিনগুলোতে আরও সতর্কভাবে বিএনপির নেতৃত্বে এগোবে তারা। বিএনপির দলীয় নেতাদের প্রকাশ্য বক্তব্যে আলী রীয়াজ সম্পর্কে আপাতত বেশি নেতিবাচক কিছু না বলারও পরামর্শ আছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের।
সবশেষ অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপির নেতারা ব্যাপক আলোচনার পর জুলাই সনদ ইস্যুতে সরাসরি প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের উদ্বেগ তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ওই বৈঠকে আলী রীয়াজের প্রসঙ্গও দলটি উল্লেখ করবে বলে সুখবর ডটকমকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য। তার মতে, সংস্কার বাস্তবায়ন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের প্রতিক্রিয়া জানানো নিয়ে উভয়সংকটে পড়েছে দলটি।
তিনি বলেন, নির্বাচনী প্রস্তুতিতে মনোযোগ দেওয়া বিএনপি ভাবতেও পারেনি যে, এমন একটি পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে। দলটি এখন বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। দলটি যদি জুলাই সনদ প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে ধরে নেওয়া হবে যে তারা সংস্কারের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। এতে তারা বিব্রতকর অবস্থায় পড়বেন। আবার যদি সবকিছু মেনে নেয়, তাহলে হয়ে যাবেন তারা পরাজিত পক্ষ। দলটিকে এমন উভয়সংকটের মুখোমুখি করা করার পেছনে গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আছে।
তিনি এমনও মনে করেন, 'মূলত নিজেদের প্রতিশ্রুতি রাখতে না পেরে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা হারানোর পর জুলাই সনদ ইস্যুতে বিএনপির চেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার ও ঐকমত্য কমিশন। গত ১৭ই অক্টোবর যে জুলাই সনদে সই করা হয়েছে, তার সঙ্গে এর বাস্তবায়নের সুপারিশের মিল নেই।'
এদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ প্রকাশের পর তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। দীর্ঘ প্রায় ১৪ মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর গত ২৮শে অক্টোবর ড. রীয়াজের নেতৃত্বে কমিশনের সদস্যেরা তাদের চূড়ান্ত সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করেন। এর পর দেশের রাজনৈতিক পক্ষগুলোর প্রধান অংশীদার বিএনপি হতাশা ও বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। গণতন্ত্র মঞ্চ ও ১২ দলীয় জোটের নেতাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তাদের অনেকে বিএনপির এই অবস্থানের সঙ্গে একমত।
বিএনপি এর জন্য দায়ী আলী রীয়াজের নাম না বললেও দলটিকে সমর্থন দেওয়া দৈনিক ইনকিলাব ৩০শে অক্টোবর সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে 'জুলাই সনদ বাস্তবায়নে অনৈক্য ও বিভক্তির আশঙ্কা: আলী রীয়াজ দায়ী' শিরোনামে। বিএনপির নেতারা বলছেন, 'দলের মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে ওই সম্পাদকীয়তে। আর ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বিএনপি যে ক্ষুব্ধ হয়েছে, এর প্রকাশ ঘটছে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যে।' এসব বিষয়ে নানাভাবে চেষ্টা করেও সুখবর ডটকম আলী রীয়াজের বক্তব্য জানতে পারেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, 'বিএনপি যে সমস্যায় পড়েছে, সেটা দলের জন্য ক্ষতিকর হবে। নানা পরিস্থিতিতে দলটি ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। এখন যদি তারা যথাযথ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে নিজেদের আরও ক্ষতি করবে।' তার পরামর্শ, বিএনপির উচিত এমন একটি কৌশল তৈরি করা, যাতে সরকার চাপের মুখে থাকে, আবার নির্বাচনে দেরি হওয়ার মতো ঘটনাও না ঘটে। বিএনপি যদি আন্দোলনে যায়, তাহলে নির্বাচনের সময়সূচি কীভাবে ঠিক থাকবে? যেকোনো ধরনের অস্থিরতায় তাদের দাবি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জানা গেছে, আলী রীয়াজ ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে জাসদ, পরে বাসদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছাত্ররাজনীতিতে প্রথমে তিনি দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রয়াত মহাসচিব ও সাবেক মন্ত্রী জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর অনুসারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে। এই সংঘর্ষের খবর তখন ঠাঁই পায় দেশের জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে।
জিয়াউদ্দিন বাবলু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ১৯৮২-'৮৩ মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা কালে বাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৩ সালে তিনি ডাকসুর জিএস থাকা অবস্থায় সামরিক শাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদের জাপায় যোগ দেন। পড়াশোনা শেষে ড. রীয়াজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর শিক্ষকতাও করেন।
একপর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে ড. রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি আটলান্টিক কাউন্সিলের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের (এআইবিএস)-এর প্রেসিডেন্ট। তিনি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক বলেও অভিযোগ আছে। ড. ইউনূসের সরকারের আমলে তিনি দেশের সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
খবরটি শেয়ার করুন