ফাইল ছবি (সংগৃহীত)
বিদেশে বাংলাদেশের ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর তৈরি পোশাক শিল্প। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা দেখলেই যেকোনো প্রবাসীর গর্বে বুক ফুলে ওঠে।দেশের মানুষের শ্রমে-ঘামে বেড়ে ওঠা একটি শিল্প হলো গার্মেন্টস। যা বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করতে পোশাক শিল্পের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তিনটি রপ্তানিমুখী খাতের মধ্যে পোশাক শিল্পই প্রধান।
বিশ্বের যে দেশগুলো যত উন্নত সে দেশগুলো তত শিল্পনির্ভর। যেকোনো দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে সে দেশের শিল্পের উপর নির্ভরশীল।বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হলেও এখানে শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। আর এক্ষেত্রে গার্মেন্টস শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। গোটা বিশ্বে পোশাক শিল্প বাংলাদেশকে ব্রান্ড করছে।
বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬০ সালে। দেশে প্রথম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি স্থাপিত হয় ঢাকার উর্দুরোডে যার নাম রিয়াজ গার্মেন্টস। প্রাথমিকভাবে রিয়াজ গার্মেন্টস-এর উৎপাদিত পোশাক স্থানীয় বাজারে বিক্রয় করা হতো। ১৯৬৭ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস-এর উৎপাদিত ১০,০০০ পিস শার্ট বাংলাদেশ হতে সর্বপ্রথম বিদেশে (ইংল্যান্ডে) রপ্তানি করা হয়। তবে বাংলাদেশের গার্মেন্টসের যে অগ্রযাত্রা সেটা স্বাধীনতার পরে শুরু হয়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে রপ্তানির যাত্রা শুরু করে। সে বছর মাত্র ৭ হাজার মার্কিন ডলার রপ্তানি হয়েছিল। কিন্তু সাহসী উদ্যোক্তা এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সে সময় খাতটির তেমন অগ্রগতি হয়নি। গার্মেন্টস প্রস্তুতকারক ও গার্মেন্টস রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে প্রকৃতপক্ষে ১৯৮১-৮২ সালে ০.১ বিলিয়ন ডলার রেডিমেইড গার্মেন্টস রপ্তানি করে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের পদচারণা শুরু হয়।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় ৯৪ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউভুক্ত দেশগুলোতে যায়। ২০০৮ সালে বিশ্বে মন্দা দেখা দেয়ার পর অনেকে আশঙ্কা করেছিল তৈরি পোশাক রপ্তানি কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তখন গার্মেন্টস শিল্পের রপ্তানি কমে যায়নি। বরং তখন সরকারের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন পলিসির কারণে বাজার ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
বর্তমানে বিশ্বে গার্মেন্টস শিল্প একটি লাভজনক ব্যবসা।সেজন্য অনেক দেশই এই শিল্পে এগিয়ে এসেছে। বিশেষ করে শ্রমের মূল্য যেসব দেশে তুলনামূলক কম সেসব দেশে পাশ্চাত্যের দেশগুলো তাদের প্রস্তুতকারক এজেন্ট নিয়োগ দিচ্ছে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপের বেশির ভাগ বাজার দখল করে নিয়েছে চীন। ‘মেড ইন চায়না’ এখন একটি পরিচিত নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে।তাছাড়া ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও মেক্সিকো প্রভৃতি দেশেও ম্যানুফ্যাক্সারিং ফ্যাক্টরি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক বিক্রেতারা। এর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে- মূল্যের সাশ্রয়। বিশেষ করে কম শ্রমমূল্যে ভালো কোয়ালিটির তৈরি পোশাক বাজারজাত করা।
করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, অব্যাহত মুদ্রাস্ফীতির পর শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। যার কারণে বারবার শ্রমিক অসন্তোষের কারণে প্রতিনিয়তই কারখানা বন্ধ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। যার প্রভাব সামগ্রিক শিল্পের উপরই পড়ছে।ইতোমধ্যে কার্যাদেশ ১০ শতাংশ কমে গেছে এবং সমপরিমাণ কার্যাদেশ অন্য দেশে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বিজিএমইএ সূত্র বলছে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনুকূল নয় বলে ইতোমধ্যে অনেকগুলো ইন্ডিয়াতে প্লেস হয়ে গেছে। নিরাপদ শিপমেন্ট ও ডেলিভারির প্রত্যাশায় অর্ডারগুলো ইন্ডিয়াতে প্লেস করা হয়েছে। আশংকা করা হচ্ছে, ২০-২৫ শতাংশ অর্ডার ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম কিংবা কম্বোডিয়ায় চলে যাবে।
বিদেশী বিনিয়োগকারীরা সহজলভ্য শ্রম বিবেচনায় বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য বস্ত্র ও পোশাক খাতকেই সবচেয়ে বেশি অনুকূল মনে করেছিল। আবার গ্যাস-বিদ্যুতের মতো ভৌত অবকাঠামো ব্যয়ও তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে কম। সব মিলিয়ে একসময় বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণের ক্ষেত্র ছিল বস্ত্র ও পোশাক খাত। কিন্তু এখন বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ আকর্ষণ হারাচ্ছে।
দেশের শিল্পায়নের বয়স চার দশকের বেশি হলেও এ সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম খাতেই বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে। তবে তারমধ্যে মধ্যে বস্ত্র ও পোশাক খাতেই সবচেয়ে বেশি এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, এখনো বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের কেন্দ্রে বস্ত্র ও পোশাক খাত, যা মোট বিনিয়োগের ২২ শতাংশ।পোশাক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, যেকোনো মূল্যে পোশাক খাত রক্ষা করতে হবে। যদি অব্যাহতভাবে অস্থিরতা চলতে থাকে তাহলে হুমকির মুখে পড়বে। ফলে বাংলাদেশে মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটবে।
ওআ/ আই.কে.জে /