সোমবার, ৮ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৪শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের দশ বছর পূর্তি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ১১:০১ পূর্বাহ্ন, ২৫শে এপ্রিল ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

২০১৩ সালে ঘোষিত, বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রাথমিকভাবে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবিওআর) নামেও পরিচিত। এটি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈদেশিক নীতির প্রকল্প হিসেবে ঘোষিত হয়। ২০১২ সালের শেষের দিকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) সাধারণ সম্পাদকের ভূমিকা পালন করছিলেন শি। চীনের ঐতিহ্যবাহী নিউ সিল্ক রোডের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে কাজাকিস্তান এবং ইন্দোনেশিয়ার সরকারি সফরের সময় বিআরআইয়ের ঘোষণা প্রদান করেন তিনি। তিনি প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিলেন যে বিআরআই এর মাধ্যমে চীন ইউরেশিয়ার বাকি অংশের সাথে যুক্ত হতে সক্ষম হবে।

ইউরেশিয়ার অন্যান্য অংশের সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং পারস্পরিক সহযোগিতাকে আরো গভীর করতে এই উদ্যোগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তিনি।

অতএব বলা যায়, শি চীনা জাতির পুনরুজ্জীবনের চাবিকাঠি হিসেবে বিআরআইকে স্থাপন করেছিলেন। এ প্রকল্পকে চীনের স্বপ্ন হিসেবেও অভিহিত করা হয়। 

তবে শুরু থেকেই বিআরআই প্রকল্প সমালোচনার সম্মুখীন হয়। বিআরআই ঘোষণার আগে থেকেই মার্কিন-চীন সম্পর্কে অবনতি দেখা দেয়। এ প্রকল্পকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে অনেকেই। মার্কিন কর্মকর্তাদের মতে, এ প্রকল্পের দ্বারা চীন তাদের জাতীয় নিরাপত্তা লক্ষ্যগুলো পূরণ করছে। দক্ষিণ এশিয়ায়, বিআরআই প্রকল্পের মূল বিনিয়োগের ক্ষেত্র ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এলাকায় চীনের অবকাঠামো নির্মাণ এ উদ্যোগের প্রতি ভারতীয় বিরোধিতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। ২০১৫ সালে, ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই বিআরআই প্রকল্পকে চীনের স্বার্থ চরিতার্থ করার পন্থা বলে সমালোচনা করেন।

শি এর নেতৃত্বে বিআরআই প্রকল্পকে চীনের পররাষ্ট্রনীতির মূল স্তম্ভ হিসেবে দেখা হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীন সরকার বিআরআই এর বিভিন্ন লক্ষ্যও প্রণয়ন করেন, যার মধ্যে রয়েছে চীন এবং বিআরআই প্রকল্পের সাথে জড়িত দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামোগত বিনিয়োগের মাধ্যমে সংযোগ বৃদ্ধি, বৃহত্তর আঞ্চলিক সমন্বয়ের সুবিধা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অগ্রগতি ইত্যাদি।

চীন অবশ্য অবকাঠামোগত বিনিয়োগকেই বিআরআইয়ের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে অগ্রাধিকার প্রদান করেছে। বিআরআই প্রকল্প আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা গঠনে পণ্য, পরিষেবা, পুঁজি প্রবাহকে সহজতর করার জন্য রাস্তা, রেলপথ, বন্দর এবং বিমানবন্দরের মতো ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে কাজ করছে। এর মাধ্যমে চীন নতুন বাজার উন্মুক্ত করে চীনা সংস্থাগুলোর জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরিতে আগ্রহী হয়।

চীন আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে রেনমিনবি (আরএমবি) এর ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের পক্ষে সমর্থনের জন্য বিআরআইকে ব্যবহার করেছে। বিআরআই এর লক্ষ্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগ লেনদেনের ক্ষেত্রে স্থানীয় বা আঞ্চলিক মুদ্রার ব্যবহারকে উন্নীত করা এবং একক মুদ্রা (মার্কিন ডলার) এর উপর থেকে নির্ভরতা কমানো। রেনমিনবিকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ব্যবহারের জন্য বিআরআইকে ব্যবহার করেছে চীন। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক মুদ্রা চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে দেশটি। বিআরআই প্রকল্পের সাথে যুক্ত দেশগুলোকে আরএমবি মুদ্রা ব্যবহারের জন্য বাধ্য করে সৃষ্ট মুদ্রা বৈচিত্র্য চীনের নতুন আরেকটি হাতিয়ার।

চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (সিডিবি) এবং এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না (এক্সিম ব্যাংক) গুলো বিআরআই প্রকল্পের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করছে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করছে। এসব ব্যাংকগুলো পরিবহন, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ এবং শিল্প পার্কসহ অবকাঠামোগত প্রকল্পের জন্য আয়োজক দেশগুলোকে ঋণ প্রদান করে থাকে। 

ব্যাংক ছাড়াও চীন বিআরআই এর উন্নয়ন ও অর্থায়নের জন্য দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠা করেছে। চীন এবং স্বতন্ত্র অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যকার চুক্তিগুলো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, যেখানে চীন বিআরআই প্রকল্পের জন্য ঋণ, অনুদান বা অন্যান্য সহযোগিতা প্রদান করে থাকে। তাছাড়া চীন সরকার দ্বারা পরিচালিত এবং চীনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্বারা সমর্থিত অর্থায়ন সিল্ক রোড ফান্ড বা এসআরএফ রয়েছে। ২০১৪ সালে বিআরআইকে সমর্থন করার জন্য ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের তহবিল নিয়ে শুরু হয় এসআরএফ। এর মাধ্যমে বিআরআই প্রকল্প সম্পন্নের জন্য চীন সরাসরি বিনিয়োগ করতে পারে। 

২০১৫ সালে চীন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক, যা ডব্লিউবিজি এবং আইএমএফের সাথে কাজ করে এবং এশিয়ায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অর্থায়নে বিশেষভাবে ভূমিকা রাখে। এআইআইবি এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য চীন এর কার্যক্রমের সাথেও জড়িত রয়েছে। ফলে এআইআইবি বিআরআই প্রকল্পের অর্থায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে উঠেছে। 

আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সহযোগিতামূলক কাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিআরআইকে বিশ্বব্যাপী একটি বৃহত্তর মাত্রায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে চীন। চীন বিশ্বব্যাংকের সাথে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে যার মাধ্যমে বিআরআই বিশ্বব্যাংক থেকে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা লাভ করে। এ সমঝোতা স্মারকে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), এআইআইবি, ইউরোপীয় ব্যাংক, ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক, নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও সহস্বাক্ষর করে।

তবে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ বিআরআই প্রকল্পের অধীনে চীনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে বিরাট বড় ঝামেলায় পড়েছে। কোভিড-১৯ এর ফলে সারাবিশ্বের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাবে পড়েছে। এমন অবস্থায় ঋণের দুর্দশাও আরও খারাপ হয়েছে। যেমন, শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশগুলোর মধ্যে একটি যা বিআরআই এর অংশ হয়ে উঠে। কিন্তু ২০২২ সালের শেষ নাগাদ দেখা যায়, চীনের কাছে প্রায় ৭৪ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ রয়েছে শ্রীলঙ্কার। ২০১৭ সালে, শ্রীলঙ্কা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে হাম্বানটোটা বিমানবন্দর চীনকে লিজ দেয়। কোভিড শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে ব্যাপক আঘাত হানে। পর্যটন হ্রাস এবং চীনের কাছে ঋণের বোঝা শ্রীলঙ্কাকে ধ্বংস করে দেয়। শ্রীলঙ্কার পর পাকিস্তানও বিআরআই প্রকল্পের অংশ হিসেবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।

কোভিড-১৯ চীনা অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। চীনেই এই মহামারীর সৃষ্টি হয় এবং এর কারণে চীনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। কঠোর লকডাউনের ফলে চীনা পণ্যের বৈশ্বিক চাহিদা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এটি চীনের রপ্তানিমুখী শিল্পের উপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তবে এ ক্ষতিপূরণে নতুন নতুন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চীন। 

শুরু থেকেই বিআরআই প্রকল্প সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল এবং দশ বছর পর এসে এই প্রকল্প অনেক দেশের জন্যে ক্ষতিকারক হয়ে উঠেছে। সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে এ প্রকল্প। মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কারণে এ প্রকল্পের প্রতি চীনা দৃষ্টিভঙ্গিও ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। বর্তমান সময়ে বিআরআই প্রকল্পের প্রতি বিভিন্ন দেশের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে।

এমএইচডি/ আই. কে. জে/

আরো পড়ুন:

বহিরাগত নাগরিকদের উপর চীনের দমন-পীড়ন নীতি

চীন বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্প

খবরটি শেয়ার করুন