বুধবার, ৩রা জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৮ই আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ও সম্মানজনক উপায়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবদল

অরুণ কুমার গোস্বামী

🕒 প্রকাশ: ০২:৩৩ অপরাহ্ন, ৮ই মে ২০২৩

#

প্রফেসর ড. অরুণ কুমার গোস্বামী

বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ও সম্মানজনক উপায়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবদলের সাক্ষি হয়ে রইল এদেশের মানুষ ও গোটা বিশ্ব। বঙ্গভবনে এক আড়ম্বরপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ-এর মেয়াদ পূরণের পর ক্ষমতা হস্তান্তর শেষে তাঁকে রাজকীয়ভাবে বিদায় জানানো হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৫০(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে একজন রাষ্ট্রপতি “একাদিক্রমে হউক বা না হউক-দুই মেয়াদের অধিক রাষ্ট্রপতির পদে কোন ব্যক্তি অধিষ্ঠিত থাকিবেন না।” সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পরপর দুই মেয়াদে ২০ এবং ২১তম রাষ্ট্রপতি পদে মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ অধিষ্ঠিত ছিলেন। আব্দুল হামিদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২২তম রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন আহমদের নিকট তিনি ২৪ এপ্রিল (২০২৩ সাল) ক্ষমতা হস্তান্তর  করেন। এর দ্বারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্থিতিশীল রাষ্ট্র তথা পলিটিক্যাল অর্ডার বা রাজনৈতিক শৃঙ্খলাপূর্ণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তা তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাস্তবায়িত হচ্ছে। গত ৩০ এপ্রিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ভালো কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা (২০১১) বলছেন, একটি আধুনিক রাজনৈতিক শৃঙ্খলাপূর্ণ ব্যবস্থা বা পলিটিক্যাল অর্ডার-এর তিনটি উপাদান - ‘একটি শক্তিশালী এবং সক্ষম রাষ্ট্র’, ‘আইনের শাসন’ এবং ‘জবাবদিহিতা’। স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন (১৯৬৮) এবং ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা (২০১১) প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ পরিবর্তনশীল তথা উন্নয়নশীল সমাজে ‘পলিটিক্যাল অর্ডার’ বা ‘রাজনৈতিক শৃঙ্খলাপূর্ণ ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার পথে গুরুতর অনেক সমস্যার কথা বলেছেন। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। এখানেও পলিটিক্যাল অর্ডার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এতকিছু সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকার সফলতার সাথে সেগুলো মোকাবেলা করে ‘পলিটিক্যাল অর্ডার’ বা ‘রাজনৈতিক শৃঙ্খলাপূর্ণ ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন বলেই ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ও সম্মানজনক উপায়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবদল’ সম্ভব হয়েছে। 

ফ্রান্সিস  ফুকুইয়ামা তাঁর ‘দি অরিজিনস অব পলিটিক্যাল অর্ডার’ গ্রন্থে বলছেন, ভাল ‘রাজনৈতিক সমাজ’ অর্জন করা খুবই কঠিন এবং সঠিকভাবে তা আনার জন্য অনেক কিছু করা প্রয়োজন। এ থেকে যে ইতিবাচক বার্তা পাওয়া যাচ্ছে, তা হলো, যদি পলিটিক্যাল অর্ডার বা ‘রাজনৈতিক শৃঙ্খলাপূর্ণ ব্যবস্থায়’ পৌঁছানো একটি ‘হ্যাপাজার্ড বিজনেস’ বা ‘এলোমেলো কাজ’ হয়, তবে এর অর্থ সেখানে পৌঁছানোর ‘অনেকগুলি উপায়’ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘পলিটিক্যাল অর্ডার’ প্রতিষ্ঠার পথে উপস্থিত ‘হ্যাপাজার্ড কাজগুলো’ জনগণের আকাঙ্খিত ‘উপায়ে’ মোকাবেলা করে বাংলাদেশ সে পর্যায়ে পৌঁছেছে! ২১তম রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ২২তম রাষ্ট্রপতির নিকট সাংবিধানিক বিধি-বিধান মেনে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনা দ্বারা তাই প্রমাণিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এটিও বলা সঙ্গত যে দায়িত্ব হস্তান্তর শেষে বিদায়ী রাষ্ট্রপতিকে প্রথমে বাদ্যযন্ত্রীদল সমভিব্যহারে বঙ্গভবনের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া এবং তারপরে আনুষ্ঠানিকভাবে এসএসএফ তাঁকে ‘নিকুঞ্জ’স্থ বাসভবনে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে বিদায় জানানোর একটি ‘অভিজাত রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ প্রতিষ্ঠিত হলো। বর্তমান লেখায় অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আকারে ১ম থেকে ২১তম রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বদলের ঘটনাগুলো ‘পলিটিক্যাল অর্ডার’দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। 

জনগণের দ্বারা নিরঙ্কুশভাবে নির্বাচিত জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক আনুষ্ঠানিক ও বৈধভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার পর শুরু হয়েছিল বাঙালি জাতির কাক্সিক্ষত ‘স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার ভিত্তিতে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল নির্বাচিত প্রতিনিধিরা গঠন করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এই সরকার শপথ গ্রহণ অর্থাৎ দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসাবে ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ - ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে হিসাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি। এই জাতিরাষ্ট্রের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন স্বদেশ বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে ‘রাষ্ট্র’ নামক ‘পলিটিক্যাল অর্ডার’ এর প্রথম উপাদান প্রতিষ্ঠার শর্ত পূরণ হয়েছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই রাষ্ট্রটিকে ‘শক্তিশালী ও সক্ষম’ করে সেখানে ‘আইনের শাসন’ এবং ‘জবাবদিহিতা’ প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি জাতির নয়নের মনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।  এক্ষেত্রে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ সফলতাও অর্জন করেছেন। তবে এজন্য তাঁকে অনেক জটিল ও কঠিন বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই বাধাগুলোকে বঙ্গবন্ধু অতিক্রমও করছিলেন প্রশংসিত উপায়ে। যা জনগণ সমর্থনও করছিল স্বতস্ফূর্তভাবে। 

পলিটিক্যাল অর্ডার এর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী যদি আমরা বিবেচনা করি তাহলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবদলের পরিস্থিতিকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথম ভাগে আছেন সেইসব জনপ্রতিনিধত্বকারী সরকার যারা বাংলাদেশে ‘পলিটিক্যাল অর্ডার’ প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। আর দ্বিতীয় ভাগে আছে সেইসব শাসকেরা যারা বাংলাদেশে ‘পলিটিক্যাল ডিজঅর্ডার’ বা ‘রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা বা অরাজকতা সৃষ্টির উৎসাহদাতা। বিশৃঙ্খল এই শক্তি পাকিস্তান প্রেমী। 

প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, এবং পঞ্চম রাষ্ট্রপতির মেয়াদকালে এবং ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে ‘পলিটিক্যাল অর্ডার’ প্রতিষ্ঠার পক্ষের তথা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন। এই মেয়াদগুলোতে যারা রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশে ‘পলিটিক্যাল অর্ডার’ বা ‘রাজনৈতিক শৃঙ্খলাপূর্ণ ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা প্রচেষ্টার সাথে আন্তরিকভাবে সামিল ছিলেন। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষাণা, ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন, ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন এসবেরই প্রমাণ বহন করে।  সবকিছু জনগণের আকাঙ্খা অনুযায়ী চলছিল।

কিন্তু রাজনৈতিক অরাজকতার পক্ষের পাকিস্তান প্রেমীরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই ‘পলিটিক্যাল অর্ডার’ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। এর পর থেকে সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম, একাদশ, এবং দ্বাদশ রাষ্ট্রপতির মেয়াদ কাল ‘পলিটিক্যাল ডিজঅর্ডারের’ বা ‘রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা বা অরাজকতার’ পক্ষের শক্তির বা মূলত পাকিস্তান প্রেমীদের দখলে ছিল বাংলাদেশ। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর, তৎকালীন ভাইস-প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ নতুন ভাইস-প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। ওই দিনই এরশাদ পদত্যাগ করেন এবং শাহাবুদ্দিন আহমেদ দেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। চতুর্দশ রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিএনপি-র আব্দুর রহমান বিশ্বাস। পলিটিক্যাল ডিজঅর্ডার বা রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা বা অরাজকতা ছিল এ মেয়াদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ষোড়শ রাষ্ট্রপতি ডা.একিউএম বদরুদ্দৌজা চৌধুরী, সপ্তদশ রাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার মুহম্মদ জমিরুদ্দিন সরকার  এবং অষ্টাদশ রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ-এর মেয়াদকালগুলোতেও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা বা অরাজকতার এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। 

জাতীয় সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে জনাব জিল্লুর রহমান উনিশতম রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা গ্রহণ করেন।  তিনি চিকিৎসার্থে ১৪ মার্চ ২০১৩ সিঙ্গাপুর যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদের স্পীকার জনাব মো. আব্দুল হামিদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে ২৪ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে জাতীয় সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে বিংশতম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০তম রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে পুনরায় একুশতম রাষ্ট্রপতি হিসাবে ২৪ এপ্রিল ২০১৮ থেকে ২০২৩ এর ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন শেষে ২২তম রাষ্ট্রপতি জনাব মো. সাহাবুদ্দিন এর নিকট দায়িত্ব হস্তান্তর করে তিনি বিদায় গ্রহণ করেন। 

প্রথম থেকে একুশতম রাষ্ট্রপতির মেয়াদান্তে ক্ষমতাবদল সম্পর্কে উপরের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা শেষে উপসংহারে আমরা একথা বলতে পারি যে,  ‘পলিটিক্যাল অর্ডার’ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী রাজনৈতিক শক্তি যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থাকার জনসমর্থন লাভ করে তখন রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধান মন্ত্রীর ক্ষমতাবদলের কাহিনী হয় সুষ্ঠু ও সংবিধানসম্মত। আর এর বিপরীতে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা বা অরাজকতার পক্ষে অথবা পলিটিক্যাল অর্ডার প্রতিষ্ঠায় বিরোধী বা অনাগ্রহী রাজনৈতিক শক্তি যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে বা আসীন হতে সক্ষম হয় তখন রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাবদলের ঘৃণ্য ও ন্যক্কারজনক ইতিহাস রচিত হয়।
 

প্রফেসর ড. অরুণ কুমার গোস্বামী, পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা। সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, এবং সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। 
 

Important Urgent

খবরটি শেয়ার করুন