শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৮ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যে কারণে শিশুদের সৃজনশীল বই পড়া জরুরি

উপ-সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০২:৩৮ অপরাহ্ন, ৩১শে আগস্ট ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

কাকলী প্রধান

আমার এক পরিচিত বড় বোনের বাসায় গিয়েছিলাম। দেখি বুক সেলফে থরে থরে বই সাজানো। বইগুলো লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা। তাতে আবার ধুলার আস্তর পড়ে মৌন মলিন দশা। কেন? কারণ, সেই বোনের মেয়ে পড়াশোনায় দারুণ ভালো। কোনোদিন স্কুলে দ্বিতীয় হয়নিপ্রতিবছর প্রথম স্থান অধিকার করার জন্য বই পুরস্কার পায়। কিন্তু স্কুলের পড়াশোনার চাপ, ব্যক্তি অনীহা এবং সর্বোপরি আমার সেই পরিচিত বোনের সোজাসাপ্টা ভাষ্য—বই পড়ে নষ্ট করার মতো ফালতু সময় নেই। আগে মেডিকেলে চান্স পাক তারপর যত বাইরের বই পড়তে ইচ্ছে হবে পড়বে।

তাই ওগুলো ঠিক যেমনটি পেয়েছিল তেমনি রয়ে গেছে। পাঠককে জানিয়ে রাখি সেই মেয়ে কিন্তু সত্যিই এখন ডাক্তার। নামী স্কুল, কলেজ তারপর সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ!

আমার খুব কাছের এক শিশুর গল্প বলি। এই শিশুর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা চোখের সামনেই। মাত্র দুই আড়াই বছর বয়স থেকে ও অনর্গল কথা বলে। কঠিন কঠিন গান অবলীলায় ওর কণ্ঠ সহজে ধারণ করে। কবিতা ওর চোখে মুখে। নিজে নিজে স্ক্রিপ্ট তৈরি করে অত্যন্ত সুন্দর বাচনভঙ্গিতে সে একা একাই উপস্থাপনা করে যায়।

২০২৩ সালে ও খুব নামী স্কুলে ভর্তি হলো। ক্লাস থ্রি। কিছুদিন আগে কয়েকজন শিশুকে নিয়ে একটি কাজ করতে চেয়েছিলাম। তাই ওকে নিয়ে এলাম। ওর সামনে ক্যামেরা ধরতেই ও আড়ষ্ট হয়ে গেল। ওকে যখন গল্পের বইগুলো পড়তে দেওয়া হলো তখন ওর কণ্ঠস্বর আমার বুকের খুব গভীরে পদাঘাত করতে লাগলো।

খুব আদর আর ভালোবাসার এই শিশুটির সমস্ত চঞ্চলতা মাত্র ৮ মাসের মধ্যে হত্যা করেছে স্বনামধন্য বিদ্যালয়টি এবং সঙ্গে জন্মদাতা-দাত্রীদয়। শিশুটিকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া হয়। ডাক্তার জানিয়েছেন ফুটফুটে এই শিশুটি এংজাইটি (Anxiety)-তে ভুগছে। হাই ঈশ্বর! কী ভয়ানক কথা। এই বয়সে এংজাইটি?

আমরা তো খেলাধুলা করেই সময় পেতাম না।  হুড়মুড় করে ঘণ্টা দুই পড়লেই কেল্লাফতে। ঘুমানোর আগেও পারলে লুকোচুরি খেলতাম। আর ঘুমানোর সময় সবার হাতে হাতে একটা করে গল্পের বই। এংজাইটির মতো ভারী ভারী শব্দগুলো তো এই কালে এসে শুনলাম। কিন্তু বললে হবে কী, আমাদের সময় তো কবেই হয়েছে গত।

যাই হোক, এই শিশুটি স্কুলের ভালো ছাত্রের তালিকায়, ভালো ফলাফলের ঘূর্ণি চাকার তলায় পড়ে গেছে। ওর খেলার সময় নেই, গান গাওয়ার সময় নেই।‌ পাঠ্যবইয়ের বাইরে গল্পের বই এখন ওর কাছে জঞ্জাল সময়ক্ষেপণ মাত্র। ওকে ডাক্তার হতেই হবে অথবা ইঞ্জিনিয়ার। এটা আসলে কার চাওয়া? বিদ্যালয়ের? না।

স্কুলে দুই একজন ভয়ংকর পড়ুয়া সবসময়ই থাকে। যারা শুধু পাঠ্যবই পাগলের মতো মুখস্থ করে। কিন্তু গোটা জাতিকে বই বিমুখ করার অসাধু চিন্তা কখনোই ছিল না বোধহয়। গল্পের বই পড়ে শোনানোর নিয়মটি উধাও হয়ে গেল।

বিদ্যালয়গুলোর তো শুধু পড়িয়ে পড়িয়ে হেস্ত ন্যস্ত করে অনাবিল শৈশব কেড়ে নিয়ে শিশুদের একটা কিছু বানিয়ে দেওয়ার কাজ।‌ কার উঠোনে কতগুলো জিপিএ-৫ এসে জুটলো তার বিস্তর আয়োজন।

ভালো স্কুলের তকমাটি প্রয়োজন তাদের। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার এইসব তো বাবা-মার চাওয়া। অসম্ভব অসভ্য বর্বরোচিত চাওয়া। বাবা-মায়েদের হীন চাওয়ার বলি আমাদের আগামী প্রজন্ম। এরা জানে না পৃথিবী কোথায় চলেছে।

পড়াশোনা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, গণিত, ভূগোল কোথায় চলে গেছে এরা জানে না। খবর নিয়ে জানা গেছে, আজকাল মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের চেম্বারে শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে এবং তথ্য সংগ্রহে আরও জানা যায় যে, অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপে শিশুদের মানসিক ভারসাম্যহীনতার প্রবণতা বাড়ছে।

যখন খুব ছোট ছিলাম তখন আমাদের জন্মদিনগুলোয় অনেক বই উপহার পেতাম। আমরাও বিশেষ বিশেষ দিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম বড়দের কাছ থেকে, বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে বই উপহার পাওয়ার জন্য। সারা বছর এই প্রতিযোগিতা সেই প্রতিযোগিতা, সেইসবেরও পুরস্কার বই।

নিয়মিত পাবলিক লাইব্রেরিতে যাতায়াত। বই আনা নেওয়া। খালা, মামা, চাচা, ফুপু সব বাসাতেই বই সংগ্রহের হিড়িক। ওইটাই নেশা। খেলা এবং বিচিত্র ধরনের বই পড়াই তো ছিল সেই সময়ের কাজ। ওইটাই ছিল আনন্দ।

মোবাইলে ভিডিও গেমস ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাকে খাওয়ানো এখন সহজ উপায়। মা-শিশুর অবসর সময় কাটে মোবাইল দেখে। ফলাফল কিছুদিন পর ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি। কী? বাচ্চা কথা বলে না, বাচ্চা খায় না, বাচ্চা একা থাকতে পছন্দ করে। আসলে বাচ্চার আগে বাচ্চার মা-বাবা নামক অভিভাবকদের চিকিৎসা প্রয়োজন এবং তারও আগে চিকিৎসা প্রয়োজন পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার।

চিকিৎসা প্রয়োজন শিক্ষা এবং পাঠদানের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি দায়িত্বশীল শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারীদের। একুশে বইমেলায় শিশু চত্বরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই বোঝা যায় বাঙালি পিতা-মাতা কোন পথ ধরে কোথায়, কীসের নেশায় চলেছেন। বিভিন্ন প্রকাশনীতে গিয়ে তারা খোঁজেন গাইড বই, গ্রামার বইসহ স্কুল উপযোগী বিভিন্ন ধরনের পাঠ্য বই।

বহু বাবা-মা একুশে বইমেলার মূল ধারণা সম্পর্কে অবহিত নন। কারণ বিদ্যালয়, শিক্ষা এখন যথাক্রমে বাজার এবং উপযোগ শব্দের সাথে সম্পৃক্ত। বিদ্যালয়গুলো এখন অর্থনৈতিক লেনদেন এবং লাভ লোকসানের উন্নত বাজার। অথবা সোজা সাপ্টা বলা যেতে পারে বিদ্যালয় এখন একটি শোষণ যন্ত্রের কারখানা।

শিশু যেন আনন্দময় পাঠের মধ্য দিয়ে বড় হতে পারে, সৃজনশীল হতে পারে সেই উপায়গুলো অনেক গবেষণা করে উপস্থাপন করতে চাই। কিন্তু অভিভাবকদের চাওয়া ভিন্ন।

আমরা কতিপয় মানুষ শিশু প্রকাশনার মতো অলাভজনক একটি কাজের সাথে জড়িত।‌ আমরা শিশুদের নদী ভালোবাসতে শেখাতে চাই। পাখি, ফুল, লতা, পাতা, ভালোবাসতে শেখাতে চাই। শিশু যেন আনন্দময় পাঠের মধ্য দিয়ে বড় হতে পারে, সৃজনশীল হতে পারে সেই উপায়গুলো অনেক গবেষণা করে উপস্থাপন করতে চাই। কিন্তু অভিভাবকদের চাওয়া ভিন্ন।

তাদের কাছে সন্তানরা লাভ লোকসানের খতিয়ান মাত্র। তাই নদীর বই হাতে নিয়ে মা ঠোঁট উল্টে বলেন নদীর নাম জাইন্না, নদী নিয়ে পইড়া কি লাভ হইব? বাবা বই হাতে নিয়ে প্রায় ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, এইসব করে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়?

পাঠক, এইসব আমার বানানো গল্প নয়। আমার চোখে দেখা এবং শোনা অভিজ্ঞতার গল্প। আমার শিশু সন্তান যখন বিষণ্ন হয়ে অর্থহীন দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে আকাশে তখন বুঝতে হবে ও ভালো নেই। ও আকাশ, বাতাস, পাখি, ফুল কিছুই দেখছে না। ও আসলে আগামীকালের সেই আনন্দহীন স্কুল আর অন্তঃসারশূন্য পাঠ্য বইয়ের বিড়ম্বিত সকালের ভাবনায় ডুবে আছে।

অনেক অনেক বছর আগে আমার ফটোগ্রাফি ক্লাসের একটি সামান্য ঘটনার কথা বলে শেষ করব। ক্লাসে একজনের পর একজনের ছবি দেখানো হচ্ছে। চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। কম্পোজিশন নিয়ে কটাক্ষের বান চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এলো আমার ছবির পালা। আলোকচিত্রী শিক্ষক আবির আব্দুল্লাহ বললেন, কাকলী আপনি তো কবিতা পড়েন, অথচ আপনার ছবিতে কবিতা নেই! ব্যস, একজন ভালো শিক্ষকের কাজ ওইটুকুই। পাঠ্য বইয়ের বাইরের পড়াশোনা আসলে মানুষকে কম্পোজিশন শেখায়।

শিক্ষকের কাজ ছাত্রদের দৈনন্দিন জীবনে তার প্রায়োগিক বিদ্যাটা শেখানো। পাঠ্য বইয়ের বাইরে বিশাল বইয়ের ভাণ্ডার একজন ইঞ্জিনিয়ারকে নান্দনিক হতে সাহায্য করে। একজন ডাক্তারকে সুন্দর করে কথা বলতে শেখায়।‌ একজন আইনজীবীকে চৌকস করে এবং সর্বোপরি মানুষকে মননশীল রুচিসম্পন্ন হতে সাহায্য করে।

বই আসলে অর্থ সম্পদ কুড়োতে সাহায্য করে না। বই পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা পাথর, নুড়ি সংগ্রহ করতে শেখায়, যা দিয়ে মানুষ বাঁচে, স্বপ্ন দেখে। আর সেই স্বপ্ন দিয়ে একটি দেশ তৈরি হয়।

কাকলী প্রধান || আলোকচিত্রী

আই.কে.জে/

শিশু শিশুদের সৃজনশীল বই পড়া বই

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন