একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির পূর্ব শর্ত হচ্ছে উন্নত সড়ক, আকাশ ও নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা সুসংগঠিত থাকা। যোগাযোগ ও ভৌত অবকাঠামো মজবুত হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। এই লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শত শত সেতু ও সড়ক উদ্বোধন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব অবকাঠামো উদ্বোধন করেন। এর সুফল পেতে শুরু করেছেন দেশের জনগণ। এছাড়া ভৌত অবকাঠামো ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে বেশ কিছু বৃহৎ প্রকল্প এগিয়ে চলেছে।
এরই অংশ হিসেবে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দুর্ভোগ কমে যাচ্ছে ঢাকাবাসীর। ভোগান্তি কমবে যাতায়াতে। যে কোনো ব্যক্তি মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে ২০ মিনিটে যাবেন মতিঝিল। কেউ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহন ধরে ১০ মিনিটে রাজধানীর ফার্মগেট থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসবেন। আবার গাজীপুর থেকে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) দিয়ে আধা ঘণ্টায় বিমানবন্দরে যাতায়াত করতে পারবেন।
স্বস্তি পাবেন আকাশপথের যাত্রীরাও। বিমানবন্দরে গিয়ে বসার আসন না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। তৃতীয় টার্মিনাল থেকে নির্দিষ্ট সময়েই উড্ডয়ন করবে সকল রুটের বিমান। যাত্রীরা দেখবেন বিশ্বমানের এক অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন। এ তো গেল রাজধানীর চিত্র।
দ্রুততম সময়ে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে যশোর-বেনাপোল যাওয়ার সুযোগ থাকছে পদ্মা রেল সেতুর বদৌলতে। সহজে যাওয়া যাবে শিল্পশহর খুলনা থেকে সমুদ্রবন্দর মোংলায়। এর বাইরে বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামে খুলে দেওয়া হচ্ছে এশিয়ার অন্যতম কর্ণফুলী টানেল। খুলছে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে মাত্র ছয় ঘণ্টায় রেলগাড়িতে সৈকতনগরী কক্সবাজারে যাওয়ার অনন্য সুযোগ। যোগাযোগে এমন বৈপ্লবিক অগ্রগতি সাধনে গোটা জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ।
এমন যুগান্তকারী পদক্ষেপে অর্থনীতিবিদরাও গর্বের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছেন বাংলাদেশে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-ই উন্নয়নের রূপকার। তারাও এখন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেন্ট ফ্লাইভব্জার্গের ভাষায় বলছেন, বৈশ্বিক জিডিপির ৭ শতাংশ আসে বিশ্বের সকল মেগা প্রজেক্ট থেকে। এই সত্য এবং বাস্তবতা গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার, স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ভালো করেই জানেন, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়তে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। বর্তমান সরকার ১০টি মেগাপ্রকল্প নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু এবং মেট্রোরেল আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও হয়েছে।
বাকি সাতটি চালু হচ্ছে আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। এই সাতটি চালু হলেই বাংলাদেশের সার্বিক চিত্র বদলে যাবে। মাথাপিছু আয় ও প্রবৃদ্ধি আরও বেড়ে যাবে। সরকারের হাতে বর্তমানে ১০টি মেগাপ্রকল্প ছাড়াও ছোট-বড় ৫৬টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার কমপক্ষে এই সাতটি মেগাপ্রকল্প চালুর জন্য নিরবচ্ছিন্ন কাজ করছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গত বছর শুধু পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় জিডিপিতে ১ দশমিক ২ শতাংশ বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে। অর্থাৎ মেগাপ্রকল্প বিনির্মাণ ও বাস্তবায়নের ফলে দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে বাংলাদেশের চেহারা। বদলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান। যোগাযোগ অবকাঠামো, বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রে উন্নতির বিস্ময়কর অগ্রগতি পৃথিবীতে বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু (কর্ণফুলী) টানেল, থার্ড টার্মিনাল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রকল্পগুলো আজ একেকটি রূপকথা। যার রূপকার জননেত্রী শেখ হাসিনা।
শেষ হচ্ছে মেট্রোরেলের প্রতীক্ষা: আগেই চালু হয়েছিল রাজধানীর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল পরিসেবা। যোগাযোগ খাতের ইতিহাসের প্রথম মেট্রোরেল আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পরীক্ষামূলক চলাচলও শুরু হয়েছে। এখন যাত্রাীরা প্রহর গুণছেন সেপ্টেম্বর মাসে মেট্রোরেল চালু হওয়ার জন্য। বহুল প্রতীক্ষিত এই প্রকল্পের সব কাজ শেষে যখন উত্তরা থেকে মতিঝিল যাবার সুযোগ পাবেন নগরবাসী তখন কী ধরনের প্রভাব পড়বে যোগাযোগ খাতে এখন সে সমীক্ষাও শেষ। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু এই প্রকল্পটিই মেগাসিটি ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনবে। মাত্র ৩০ মিনিটেই উত্তরা থেকে মতিঝিল যাওয়া যাবে বিরতিহীনভাবে। আর বিরতিতে লাগবে ৪০ মিনিট।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে : ভৌত অবকাঠামোতে মেট্রোরেল যেমন প্রথম স্থান দখল করেছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েও তেমনই প্রথম হয়েছে যোগাযোগের নতুন ধরনে। এর আগে এ ধরনের পথ তৈরি হয়নি এ দেশে। সেজন্য ঢাকার প্রায় দুই কোটি মানুষ অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার প্রহর গুণছেন কবে নাগাদ এতে চড়বেন। এটি এমন এক প্রকল্প যাতে নেই কোনও সিগন্যাল, নেই ট্রাফিক জ্যাম। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর লাগোয়া পূর্ব পাশের কাওলা পয়েন্ট থেকে তেজগাঁও হয়ে এক টানে ফার্মগেট যাওয়া যাবে মাত্র ১২ মিনিটে। ওখান থেকে আর মাত্র ১৫ মিনিটে যাওয়া যাবে কুতুবখালী। প্রথম ফেইজ উদ্বোধন হলে প্রতিদিন গড়ে ৮০ হাজার যানবাহন যাতায়াত করতে পারবে।
স্বপ্নের থার্ড টার্মিনাল: বিমানবন্দরে যে কোনো ধরনের সেবায় সামান্য ঘাটতি ছিল। শত চেষ্টা আর পদক্ষেপ নিয়েও সেবা বিশ্বমানের নিশ্চিত করা যাচ্ছিল না। এ নিয়ে দেশে-বিদেশে সরকার প্রধানকেও নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার চির অবসান ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক মানের যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতেই থার্ড টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। এর অফিসিয়াল নাম হচ্ছে- হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় সম্প্রসারণ প্রকল্প। এটি চালু হবে আগামী অক্টোবর মাসের ৭ তারিখে।
সরকারি অন্যান্য ভৌত পরিকল্পনা: যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৭ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে সরকার। যা বিগত অর্থবছরে ছিল ৮১ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। এ হিসেবে ৬ হাজার ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
সরকারের উদ্দেশ্য যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে অর্থাৎ সড়ক, সেতু, রেল, নৌ ও আকাশপথের সমন্বিত উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেয়া। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিরাপদ, টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী যোগযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এজন্য চলমান কার্যক্রমগুলোর বাস্তবায়ন ও বাস্তবায়ন পরবর্তী মান সংরক্ষণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে সড়ক, সেতু, কালভার্ট ও ব্রিজ ইত্যাদি নির্মাণের ফলে সারাদেশে ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মহাসড়ক তৈরি হয়েছে। ফলে নির্বিঘ্ন হয়েছে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা। দেশে ৭১৮ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নীত করা হয়েছে। বিভিন্ন মহাসড়কে ১ হাজার ৫৫৮টি সেতু ও ৭ হাজার ৪৯৮টি কালভার্ট নির্মাণ/পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। সড়ক যোগাযোগ সহজ করতে যুক্ত হয়েছে ১৫টি রেলওয়ে ওভারপাস ও ১৮টি ফ্লাইওভার।
বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে ২৫টি জেলায় মোট ১০০টি সেতু উদ্বোধন করা হয়েছে, যার মোট দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৪৯৪ মিটার। ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক এবং প্রায় সকল মহাসড়কের সাথে সংযোগ স্থাপিত হবে। ঢাকার সাথে ৩০টি জেলার যোগাযোগ সহজতর হবে।
২০২৬ সালের মধ্যে কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার পাতাল এবং নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩৬৯ কিলোমিটার উড়ালসহ মোট ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ২১টি স্টেশন বিশিষ্ট মেট্রোরেলের আরেকটি লাইন নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। এছাড়া বাণিজ্য সহায়ক নৌপথ, নৌবন্দর ও স্থলবন্দর ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে সরকার ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৭ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে। গত অর্থবছরে এই খাতে ৮১ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল।
অজিত কুমার মহলদার, গণমাধ্যম বিশ্লেষক এবং সাবেক নির্বাহী সদস্য, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন
খবরটি শেয়ার করুন