শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৮ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এবং ধর্মীয় উপনিবেশ পাকিস্তানের আপসোস            

অরুণ কুমার গোস্বামী

🕒 প্রকাশ: ০২:১৭ অপরাহ্ন, ১৭ই মে ২০২৩

#

অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী

উন্নয়ন অভিমুখে বিস্ময়কর সফলতাসহ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। এ সময় সাম্প্রদায়িক নীতি ও প্রবল ভারত বিরোধিতার কারণে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ধর্মীয় উপনিবেশ পাকিস্তান পঙ্গুত্বের দিকে ধাবমান। এসব দেখে কোনও কোনও পাকিস্তানী উন্নয়নশীল বিশ্বের ‘রোল মডেল বাংলাদেশের’ প্রশংসা করছে! পাশাপাশি পাকিস্তানের বিপর্যয়ের জন্য আপসোস করছে! যা ১৯৭১ সালে বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তুলনায় প্রকৃতপক্ষে গুরুত্বহীন। এই মন্তব্যের কারণ একটাই তা’হলো উন্নয়ন অভিমুখে বাংলাদেশের এই অভাবনীয় এগিয়ে যাওয়া এবং পাকিস্তানকে  ছাড়িয়ে না যেতে পারলে আজ পাকিস্তানীরা এমনটি করত না! ত্রিশ লাখ মানুষের প্রাণ, প্রায় সাড়ে তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম, কয়েক হাজার ভারতীয় সৈন্যের জীবনদানসহ বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী বিচারহীন অপরাধের বিনিময়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের কাজ করছিলেন ঠিক তখনই তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ওই বছরেরই ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা পাকিস্তানের সমর্থকগোষ্ঠী। বাংলাদেশের অভ্যন্তরস্থ পাকিস্তানের সমর্থকগোষ্ঠীর পুরোধা সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের সরকারের সময় তার নির্দেশনায় হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সৈনিককে বিনা বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এইসব হত্যাকাণ্ডসহ আরও অনেক অনেক হত্যাকাণ্ড ও বাধার প্রাচীর পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন “উন্নয়নের রোল মডেল”। 

 

যেসব পাকিস্তানীরা এখন বাংলাদেশের প্রশংসা করছেন তারা কিন্তু ১৯৭১ সালে তাদের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল তার বিচারের ব্যাপারে নিশ্চুপ! ইতিহাস এটিও সাক্ষ্য দেয় যে, সে সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশকে তো স্বীকৃতি দেয়ই নি, বরঞ্চ জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের বর্তমান আগ্রাসী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি (২১ সেপ্টেম্বর ১৯৮৮-) পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং তার স্ত্রী নুসরাত ভুট্টোর নাতি। বেনজীর ভুট্টোর পুত্র। যা হোক, ১৯৭২-এর ১০ আগস্ট একটি সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিলেন যে বাংলাদেশ যদি বিশ্বাস করে যে "আমাদের (পাকিস্তানের) বন্দীদের মুক্তির বিষয়ে তাদের এক ধরণের ভেটো আছে, (তা’হলে) আমাদের হাতেও একটি ভেটো রয়েছে।" ভুট্টো যে ভেটো-র কথা বলেছিলেন সেটি হচ্ছে চীনের ভেটো। তখন বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য হতে বাধা দিতে চীনকে তার ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। এ প্রেক্ষিতে বেইজিং ২৫ আগস্ট, ১৯৭২ বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তিতে বাধা দিতে নিরাপত্তা পরিষদে প্রথম ভেটো পাওয়ার প্রয়োগ করেছিল। 

 

সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখিত রক্তঝরা বিয়োগাত্মক পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন এগিয়ে চলেছে এবং সমগ্র বিশ্বের প্রশংসা পেয়ে চলেছে। পাকিস্তানীরা ছাড়াও অন্য অনেকেই এখন বলছেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী- শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান- তাদের অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিস্ময়কর ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কাভিত্তিক ডেইলি নিউজে প্রকাশিত জন রোজারিওর লেখা একটি ফিচার স্টোরির শিরোনাম-  “শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তান: বাংলাদেশ মডেল থেকে শিক্ষা”। স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরে পদার্পণ করার মুহূর্তে বাংলাদেশ অসাধারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। যা বাংলাদেশকে আঞ্চলিক সংযোগের একটি উদীয়মান কেন্দ্রে পরিণত করেছে এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ আকর্ষণ করছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। এসবই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক নীতি এবং গণতন্ত্রের ধারাবহিকতার ফসল। 

 

পাকিস্তানের কলামিস্ট এবং সমাজবিজ্ঞানী তাসনিম সিদ্দিকী ‘হোয়াই উই (পাকিস্তানীরা) ল্যাগ বিহাইন্ড’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছেন। তাসনিম সিদ্দিকী সেখানে বলেছেন, “সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো সামাজিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের খারাপ পারফরম্যান্স: ২৫ মিলিয়ন শিশু স্কুলের বাইরে; অব্যাহত ব্যাপক লিঙ্গ ব্যবধান; শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের নিম্নমানের; রুটিন টিকাদানে ব্যাপক ঘাটতি; বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ শিশু মৃত্যুর হার; প্রবল অপুষ্টি এবং ৪০ শতাংশ শিশুর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত। এসব দিকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা বা বুদ্ধিজীবীদের কোনও আগ্রহ নেই। 

 

গত ২০ বছরে, বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৫০০% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা পাকিস্তানের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর দ্বারা যে বাংলাদেশের অবকাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। গত ৫০ বছরে সেই বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে।  

 

কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সামর্থ্যকে প্রশংসা করেছে কানাডা ভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর রাইটস অ্যান্ড সিকিউরিটি। এই সংস্থাটি মন্তব্য করেছে যে বিশ্ব অর্থনীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে গভীর মন্দায় নিমজ্জিত এবং বহুপাক্ষিকতা ও আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নে যথেষ্ট বাধা সৃষ্টি করেছে। 

 

কীভাবে বাংলাদেশ উন্নয়নের একটি "বিস্ময়কর কাহিনী" এবং পাকিস্তান একটি "বিপর্যয়ের গল্প" হয়ে উঠেছে তা বর্ণনা করা হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর রাইটস অ্যান্ড সিকিউরিটি কর্তৃক প্রকাশিত “বাংলাদেশ এন্ড পাকিস্তান - ফর্মারলি ওয়ান ন্যাশন, টুডে অ্যা ওয়ার্ল্ড এপার্ট” (“বাংলাদেশ ও পাকিস্তান - প্রাক্তন এক জাতি, আজ একটি আলাদা বিশ্ব”) শিরোনামের একটি নিবন্ধে। 

 

এই নিবন্ধে বলা হয়েছে, মহামারীর আগেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার পাকিস্তানের চেয়ে অনেক উপরে ছিল। ২০১৮-১৯ সালে এটি  পাকিস্তানের ৫.৮% প্রবৃদ্ধির তুলনায় বাংলাদেশের ছিল ৭.৮%।

 

ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর রাইটস অ্যান্ড সিকিউরিটি এর আলোচিত নিবন্ধে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের আলাদা বিশ্ব হয়ে ওঠার কারণ হিসাবে তাদের স্ব স্ব “জাতীয় স্বার্থকে” খুব আলাদাভাবে উপলব্ধি করার বিষয়টিকে উল্লেখ করা হয়েছে। 

 

মানব উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ তার ভবিষ্যৎ দেখে। রপ্তানি বৃদ্ধি, বেকারত্ব হ্রাস, স্বাস্থ্যের উন্নতি, ঋণ ও সহায়তার উপর নির্ভরতা হ্রাস এবং ক্ষুদ্রঋণ আরও প্রসারিত করা প্রভৃতি বাংলাদেশের লক্ষ্যমাত্রা হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। অপর দিকে, পাকিস্তানের কাছে মানব উন্নয়ন তেমন কোনও গুরুত্ব বহন করে না। ‘অধিকাংশ জাতীয় শক্তি ভারতকে ঠেকানো বা ভারতবিরোধিতা এবং অতিরিক্ত রাষ্ট্রীয় নেতাদের লালনপালনের উপর নিবদ্ধ থাকে...।’

 

কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে ২০২১ সালের মে মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ৪৫.১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০২১ সালের জুনে পাকিস্তানের ১৭.১ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। 

আইএফএফআরএএস উল্লেখ করেছে যে, সত্যিকারের বিস্ময়টি এই সত্যের মধ্যে রয়েছে যে এমনকি ২০২০ অর্থবছরে, যখন বিশ্বের সব দেশের অর্থনীতি মহামারীজনিত লকডাউনের ফলে সংকুচিত হয়েছিল, তখন বাংলাদেশ ৫.২৪% বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

বাংলাদেশকে “পরবর্তী এশিয়ান টাইগার” বলেছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। এর উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন সম্পর্কে পাকিস্তানের সমাজবিজ্ঞানী তাসনিম সিদ্দিকী বলছেন, “এটি সেই একই দেশ যা ১৯৭১ সালের আগে শাসকগোষ্ঠী মনে করেছিল পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে নিচের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।” পাকিস্তানের পরিকল্পনাবিদ, নীতিনির্ধারক এবং সুশীল সমাজের নেতাদের প্রতি বাংলাদেশের এই 'উন্নয়ন বিস্ময়' দেখার জন্য এবং তা থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য পরিশেষে তাসনিম সিদ্দিকী আহ্বান জানিয়েছেন।

 

করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মুনিস আমার (২০২১) পাকিস্তানের এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতির জন্য উপযুক্ত ‘নেতৃত্বের অভাব’-কে দায়ী করেছেন। বলেছেন, উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবেই পাকিস্তানের বিপর্যয় ঘটে চলেছে।   তার কথায়, ‘পাকিস্তানের যা অভাব রয়েছে তা হলো এমন একটি নেতৃত্ব যা প্রাপ্য সুযোগ এবং সম্পদকে তার অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন এবং একটি প্রাণবন্ত রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে পারে।’

 

বাংলাদেশের সৌভাগ্য আমরা একজন দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পেয়েছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার কারণেই বাংলাদেশের এই ‘বিস্ময়কর উন্নতি’ যা দেখে ধর্মীয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র পাকিস্তান আপসোস করছে!  

 

অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী, ‘ইনস্টিটিউশনালাইজেশন অব ডেমোক্র্যাসি ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থের লেখক। পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ। সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এবং সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। 
 

Important Urgent

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন