বুধবার, ৩রা জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৮ই আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাহিত্যের ‘কালপুরুষ’ সমরেশ মজুমদার

সংস্কৃতি প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ০৬:২৩ অপরাহ্ন, ৯ই মে ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

অমিত গোস্বামী

সালটা ১৯৮৪। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছি। লিখতে পারি না, অথচ সাহিত্য নিয়ে প্রবল উৎসাহ। দায়ী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। লাই দিয়ে মাথায় তুলেছেন। ‘দেশ’ পত্রিকার অফিসে প্রায়ই যাই। একদিন সাগরময় ঘোষের পুত্র আলোকময় ঘোষ অর্থাৎ বাবুইদার ঘরে বসেছি। হঠাৎ মুখ বাড়ালেন যে ভদ্রলোক তিনি সদ্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। সমরেশ মজুমদার।

বাবুইদা সাদরে আসতে বললেন। এলেন। বসলেন আমার পাশের চেয়ারে। বাবুইদা আলাপ করিয়ে দিলেন। স্বাভাবিক নিয়মে একটা সদ্য দাড়ি গজানো ছেলেকে পাত্তা দিলেন না। প্রবল আগ্রহে বললাম—আমি সুদীপের সাথে পড়ি। সুদীপ মজুমদার সমরেশ মজুমদারের খুড়তুতো ভাই। গয়েরকাটার ছেলে। একই বাড়ির। সমরেশ মজুমদার একটু নরম হয়ে বললেন—তাহলে সুদীপের সাথে আমার বাসায় এসো।

নাহ, সুদীপ কখনো আমায় নিয়ে যায়নি। আসলে ওর সাহিত্য নিয়ে সামান্যতম আগ্রহ ছিল না। কিন্তু সমরেশ মজুমদারের সাথে আমার যোগাযোগ ঘটল। অটোমোবাইল ক্লাবের পানশালায়। আমাকে দেখে ডাকলেন—তুমি তো আর এলে না। সেই শুরু। তবে বন্ধুর দাদা বলেই হয়তো অল্প হলেও দূরত্ব রাখতেন। তবে আমার আদিবাস উত্তরবঙ্গ বলে বাড়তি একটু মনোযোগ পেতাম।

সমরেশ মজুমদার ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলেন ১৯৭৯-১৯৮০ সালে। তার দশ বছর আগে নকশালপন্থী আন্দোলন শেষ হয়ে গিয়েছে। জরুরি অবস্থার পর নির্বাচন হলো, বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলো। কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসবে, একথা ১৯৬৭ সালে বিশ্বাস করা যেত না।

'দেশ' পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের আহ্বানে তার 'উত্তরাধিকার' উপন্যাসের শুরু। ১৯৪৭ থেকে খাদ্য আন্দোলনের পশ্চিম বাংলা ছিল পটভূমি। কী করে সাধারণ মানুষ কংগ্রেস সম্পর্কে মোহমুক্ত হচ্ছে, অথচ বিরোধীরা দলবদ্ধ হতে পারছে না, তা একটি কিশোরের চোখ দিয়ে দেখালেন এবং শেষ করলেন অনিমেষ আন্দোলনে উত্তাল কলকাতায় পা দিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার ঘটনা দিয়ে। কিন্তু পাঠকরা দাবি করলেন, উপন্যাস ওখানে শেষ হতে পারে না।

কাজেই দ্বিতীয় পর্বের শুরু। উপন্যাস ‘কালবেলা’। অনিমেষ মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি থেকে সরে এসে নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। সেই সময় অনেক মেধাবী ছেলে নিজের ক্যারিয়ারের কথা না ভেবে ভারতবর্ষে মুক্তি আনার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এক দল ছিল পেছনে, যারা আন্দোলন সংগঠিত করতো, অন্য দল অ্যাকশনে নামতো।

এই চিত্র সমরেশ মজুমদার দেখেছিলেন সহপাঠী শৈবাল মিত্রের মধ্যে এবং এই শৈবাল মিত্রের আদলে তিনি গড়ে তুলেছিলেন তার উপন্যাসের চরিত্র অনিমেষ। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছি না।

‘উত্তরাধিকার’ প্রকাশিত হওয়ার পর যখন খুব সামান্য বিক্রি হয়েছে, প্রস্তাব এসেছিল, বিজ্ঞাপনে যদি লেখা হয় বইটি কমিউনিস্ট পার্টির সংগ্রামের পটভূমিতে লেখা হয়েছে, তা হলে দশ হাজার কপি কিনে নেবে সরকার। একজন নতুন লেখকের কাছে এত বিক্রি হওয়া স্বপ্নের চেয়ে বেশি। কিন্তু প্রকাশক বিজ্ঞাপন দিতে রাজি হননি। বলেছিলেন, ‘এই বিজ্ঞাপন দিলে বইটির বিক্রি শেষ হয়ে যাবে।’ পরের ইতিহাস প্রকাশককেই সমর্থন করেছে।

সমরেশ মজুমদার গয়েরকাটার চা’বাগানের ছেলে হলেও তিনি ছিলেন মূলত জলপাইগুড়ির। তার ভাষায় “যে শহরে সেই চার বছর বয়সে পিতামহ এবং বড় পিসিমার সঙ্গে এসেছিলাম, সেই জলপাইগুড়ির বড় রাস্তাগুলো তো বটেই, প্রতিটি অলিগলি চিনে ফেলেছিলাম দশ-বারো বছর বয়স হতেই।

তখন জলপাইগুড়ি শহরটা ছিল আমার আয়ত্তের মধ্যে। বারো বছর বয়স হতে না হতে সেনপাড়া থেকে মাসকলাইবাড়ি শ্মশান, পাণ্ডাপাড়া থেকে রাজবাড়ি পর্যন্ত টহল দিতাম সাইকেলে। চার বন্ধুর চার সাইকেল। তখনো তিস্তায় বিস্তর জল, বাঁধ তৈরির তোড়জোড় চললেও শীতের ভোরে বছরের শেষে হাজির হয়ে যাচ্ছে পক্ষীরাজ ট্যাক্সিগুলো।

হাকিমপাড়ায় আমার পিতামহের বাড়ি। তার গায়ের মাঠটার নাম ছিল কোচবিহার মাঠ। জলপাইগুড়ি শহরের বুকে কয়েক বিঘা জমি বুনো ঝোপ নিয়ে পড়ে থাকত, তার নাম কেন কোচবিহার মাঠ হয়েছিল বালক বয়সে তা জানতে কৌতূহলী হইনি। ঠিক তারপরেই তিস্তার ঢেউ যা বর্ষাকালে মাঠের প্রান্তে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলত।

ভর বর্ষায় হাকিমপাড়া-সেনপাড়া ছুঁয়ে যাওয়া তিস্তার জলের অন্য প্রান্ত বইতো বার্নিশকে স্পর্শ করে। তখন নদীর উপর সেতু নেই, হচ্ছে-হবে এই আশায় রয়েছে। জলপাইগুড়ির কাছারি ঘাট থেকে যাত্রী বোঝাই নৌকোর গুণ টেনে মাঝিরা নিয়ে যেত প্রায় জেলা স্কুলের কাছাকাছি। নিয়ে গিয়ে তিস্তার স্রোতে নৌকো ভাসিয়ে দেওয়া হতো।

মাঝ নদীতে নৌকো এই ডোবে কী সেই ডোবে! এ-ওকে আঁকড়ে ধরে কোন ভগবানকে ডাকবে ভেবে পেত না। দক্ষ মাঝিরা সেই নৌকা পৌঁছে দিত বার্নিশের ঘাটে। বার্নিশে যাত্রী পৌঁছে দিয়ে পরপর দাঁড়িয়ে আছে প্রচুর বাস। তাদের বাসের বাহার অনেক। কেউ যাবে আলিপুরদুয়ার, কেউ কোচবিহার, কেউ বানারহাট অথবা নাথুয়া।

নৌকোর যাত্রীরা দৌড়ে যায় নিজের জায়গায় যাওয়ার বাসে আসন পাওয়ার জন্য। ভাতের হোটেল থেকে হাঁক ভেসে আসে, ‘আসুন ভাই বোরোলি মাছ আর গরম ভাত, খাবেন আর জুড়াবেন। আসুন দাদারা।’ কালীপূজো রমরমিয়ে চলে যেতে তিস্তার জলে টান পড়ত। তারপর দুদ্দাড় করে বালির চর মাথা চাড়া দিত।

শেষপর্যন্ত জলপাইগুড়ির কাছারি ঘাটের কাছে সরু এক চিলতে তিস্তা যার গভীরতা হাঁটু স্পর্শ করে না আর ওদিকে বার্নিশের গা ঘেঁষে খানিকটা চওড়া, জল কমে এলেও কিছুটা গভীর এবং গম্ভীর তিস্তা বয়ে যায় পাকিস্তানের দিকে। তারপর তিস্তায় গায়ে বাঁধ বসল। তৈরি হলো ট্রেন এবং গাড়ি চলাচলের লম্বা ব্রিজ। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, তিস্তায় জল কমতে শুরু করল হু হু করে।

সেবক পার হওয়ার পর থেকেই তো তিস্তাকে বাঁধার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। তবু শেষবার তিস্তা চেষ্টা করেছিল আটষট্টি সালের দুর্গাপূজোর ঠিক পরে। বাঁধন ছিঁড়ে রানি তিস্তা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জলপাইগুড়ি শহরের ওপর। চুরমার করে কোমর ভেঙে দিয়েছিল শহরটার। ছাদ ভাসিয়ে যাওয়া জলের স্রোত নিয়ে গেছে কত প্রাণ।

বন্যার পরের দুপুরে ময়নাগুড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে তিস্তা ব্রিজের ওপর উঠে দেখেছিলাম, প্রায় কালো জল তখনো শোঁ শোঁ করছে। কিন্তু সেই শেষ। তিস্তা শেকলে বাঁধা পড়ল। জলপাইগুড়ি-বার্নিশের বিশাল তিস্তা গেল শুকিয়ে। সাহসী মানুষেরা সেই নদীর চরে প্রথমে অস্থায়ী, পরে স্থায়ী বাসস্থান তৈরি করে নিলো। এক চিলতে জলের ধারা, তাই নিয়েও রাজনীতির তরজা শুরু হয়ে গেল।”

২০১৬ সালে আমি যখন তিস্তার জল বাংলাদেশকে দেওয়া উচিত বলে ক্রমাগত লিখে চলেছি। একদিন আমার সাথে দেখা হতেই প্রসঙ্গটা তুললাম। একটু নীরব থেকে বললেন, মরা মায়ের কি আর ভাগ হয়? বাংলাদেশের লাভ কিছু হবে কি? তার সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ ছিল খুব গভীর। অনেক খবরই রাখতেন।

বছর দেড়েক আগে কলকাতা বইমেলায় দেখা হতেই বললেন—তুমি তো লেখার ব্যাপারে বাংলাদেশে নোঙর ফেলেছ। সব খবরই পাই। আমি বললাম—আমি বাংলাদেশে লিখতে স্বচ্ছন্দবোধ করি। বললেন—তোমার ‘হুমায়ূন’ উপন্যাসটা পড়েছি। আমার তো হুমায়ূন আহমেদের মতো প্রতিভা নেই। তাই গোগ্রাসে পড়লাম ওর জীবনের আঁধারে প্রকাশিত তোমার উপন্যাস।

জিজ্ঞাসা করলাম—আপনার কেন মনে হলো যে হুমায়ূন আহমেদের মতো প্রতিভা আপনার নেই? বললেন—মৃত্যুর পরে সুনীলদার উপন্যাসের বিক্রি অনেক অনেক কমে গেছে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরে তার বই বিক্রি একটুও কমেনি। আমার প্রকাশিত বই আমার মৃত্যুর ১০ বছর বাদে একই রকম বিক্রি হবে? হবে না। তাই…।

সমরেশ মজুমদার কি সত্যিই লেখক হতে চেয়েছিলেন? প্রথমে তো নয়ই। মাত্র ১৭ বছর বয়েসে কলকাতায় এসেছিলেন। তখন কলকাতার আকর্ষণের কেন্দ্র ছিলেন উত্তম কুমার, সত্যজিৎ রায়। তাদের মতো হতে চাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সেই কিশোর ও তার বন্ধুরা মিলে নাটক করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তৈরি হলো নাটকের দল। কিন্তু নাটক কে লিখবেন? দায়িত্ব দেওয়া হলো সমরেশ মজুমদারকে।

বন্ধুদের কথায় আগে গল্প লিখলেন। কিন্তু তার বন্ধুরা পড়ে বললো, ‘নাটকের গল্প হয়নি। তোর দ্বারা নাটক হবে না।’ তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—কেন? বন্ধুরা বললো তার নাটকের নায়ক ট্রেনে করে যাচ্ছে, সাঁতার কাটছে, এসব মঞ্চে দেখাবো কী করে? তুই বরং এই গল্প কোনো পত্রিকায় পাঠা, ছাপিয়ে দিবে।

তখন বাংলায় কলকাতার সবচেয়ে বড় পত্রিকা ‘দেশ’। ওই পত্রিকায় পোস্টে ওই গল্পটি পাঠালেন। পাঠানোর পর মাসের পর মাস পার হয় কোনো খবর নেই ছাপানোর। ছয় মাস থেকে আট মাস গেল কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ নেই।

একদিন হঠাৎ সমরেশ মজুমদার দেশ পত্রিকাতে গিয়ে বললেন, আমি একটা গল্প পাঠালাম আপনারা কি দেখেছেন? তারা বললো, গল্পের কী নাম? নাম বলার পর এক মাস পরে আসার জন্য বলা হলো।

আরও পড়ুন : আজ পঁচিশে বৈশাখ, কবিগুরুর ১৬২তম জন্মবার্ষিকী

একমাস পর আবার গেলেন পত্রিকা অফিসে তখন বলা হলো সাতদিন পরে আসতে। সাতদিন পর অফিসে গেলে জিজ্ঞাস করা হলো এটা তার গল্প কি না। তখন দেশ পত্রিকা থেকে বলা হলো গল্পটি নির্বাচিত হয়েছে। তিনি বন্ধুবান্ধবদের এই সংবাদ দিলেন। সবাই খুব খুশি হলো। দু’দিন পর তার ঠিকানায় ‘দেশ’ পত্রিকা থেকে একটি খাম আসলো।

খাম খুলে দেখেন, তিনি যে লেখা পাঠিয়েছিলেন তার কপি আর সঙ্গে একটি চিঠি। যাতে লেখা—ভবিষ্যতে ভালো গল্প লিখলে পাঠাবেন। লজ্জায় রাগে সমরেশ মজুমদার কলেজের টেলিফোনের বুথ থেকে ফোন করলেন ‘দেশ’ পত্রিকায়। তখন ‘দেশ’ পত্রিকায় গল্প দেখতেন বিমল কর। তিনি জিজ্ঞাস করলেন, কী চাই ভাই?

সমরেশ বললেন, ‘আপনারা বললেন লেখা ছাপাবেন অথচ বাসায় লেখা পাঠিয়ে দিলেন। আপনারা তো মিথ্যাবাদী।’ বিমল কর চুপচাপ কিছুক্ষণ শোনার পর বললেন, ‘আপনি গল্পটা নিয়ে আমাদের কাছে আসুন।’ এই শুনে ভয় পেলেন সমরেশ। চিন্তা করলেন এতো গালাগালি করলেন অফিসে গেলে যদি পুলিশে দিয়ে দেয়।

তারপরও সাহস করে গেলেন পত্রিকা অফিসে। পত্রিকা অফিসে যাওয়ার পর বিমল কর বললেন, ‘আমি পিওনকে বললাম লেখাটা প্রেসে দিতে। সে ভুল করে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।’ তার পরের সপ্তাহে গল্পটা দেশ পত্রিকায় ছাপানো হলো। দু’দিন পরে তার বাসায় একটা মানি অর্ডার এলো। গল্পটির পারিশ্রমিক বাবদ ১৫ টাকা ‘দেশ’ পত্রিকা পাঠিয়েছে। সেই শুরু তার সাহিত্যের ‘দৌড়’।

অমিত গোস্বামী ।। কবি ও কথাসাহিত্যিক

 

সাহিত্যে ‘কালপুরুষ অদৃশ্য

খবরটি শেয়ার করুন