জাকির হোসেন
‘বিশ্ববাজার’ শব্দটি বাংলাদেশে এখন খুবই প্রচলিত। নীতিনির্ধারকদের বক্তব্যে হরহামেশাই এর ব্যবহার হচ্ছে। গড়পড়তায় প্রায় সবাই বলছেন, করোনা-পরবর্তী চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের এখানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির কারণ ব্যাখ্যায় মোটাদাগে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববাজারকেই দায়ী করা হচ্ছে।
অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যাদের হাতে, তারা বলেই যাচ্ছেন, বিশ্ববাজার ঠিক হলে অর্থনীতি তার আগের গতি ফিরে পাবে। মূল্যস্ফীতি কমে নিম্ন আয়ের মানুষকে স্বস্তি দেবে। তারা আশ্বস্ত করছেন, ডলারের জোগান কমে যাওয়াসহ অর্থনীতির বিভিন্ন সংকট শিগগিরই কেটে যাবে। কিন্তু কোনোভাবেই অর্থনীতির সংকট কাটছে না। বিশেষত বাজারে জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। শুধু কাঁচাবাজারের পণ্যে নয়, প্রায় সব কিছুতেই মানুষের ব্যয় উচ্চহারে বেড়েছে। বেশির ভাগ মানুষ আয়ের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অবশ্য সম্প্রতি দাবি করেছেন, অর্থনীতি ভালো আছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, যারা অর্থনীতি ভালো নেই বলছেন, তারা অর্থনীতিই বোঝেন না। আমরা এ বিষয়ে দেশের স্বনামধন্য দু’জন অর্থনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের প্রতিক্রিয়ার সারমর্ম হলো– সরকারের নীতিনির্ধারকরা যদি অর্থনীতির সমস্যা স্বীকার না করেন, তাহলে সমাধানের পথও কঠিন হয়ে যাবে। শুধু অর্থনীতিবিদরা কেন; সাধারণ মানুষও নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝছেন, অর্থনীতিতে সমস্যা চলছে। সম্প্রতি দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের যৌথ জরিপে উঠে এসেছে, দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, অর্থনীতি ভুল পথে এগোচ্ছে।
করোনা কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব যে কিছুটা নেই, তা নয়। কেননা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ চেইনে কিছু সমস্যা রয়েছে। কিছু দেশ ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে সংরক্ষণমূলক নীতি নিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বিশ্ববাজারে বেশির ভাগ পণ্যের দাম বেড়ে আবার কমেছে এবং কমার এ প্রবণতা অব্যাহত। এর সঙ্গে অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা দেখিয়ে অনেক দেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে। শ্রীলঙ্কার কথাই ধরা যাক। চরম সংকটে পড়ে দেশটির মূল্যস্ফীতি এক বছর আগে ৭০ শতাংশে উঠেছিল। সর্বশেষ গত জুলাই মাসে তাদের মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশে নেমেছে। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথা বাদই দিলাম। এই অঞ্চলের ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ কিছু দেশে এখন এক বছরের আগের তুলনায় মূল্যস্ফীতি কম। প্রশ্ন উঠছে– আমরা কেন পারছি না। আমাদের মূল্যস্ফীতি কয়েক মাস ধরে ১০ শতাংশের কাছাকাছি।
যারা মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছে, তারা নিশ্চয় বিশ্ববাজারের প্রভাবের বাইরে নয়। তারা কীভাবে পেরেছে, আমরা সে বিষয়ে তেমন আলোচনা করছি না। তাদের মতোই হুবহু একই কৌশল আমাদের নিতে হবে, তাও নয়। আমাদের কৌশল আমাদেরই ঠিক করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে কথা বলতে হবে। তাদের মতামত নিতে হবে। ব্যবসায়ীরা কী ভাবছেন, তা সরকারকে জানতে হবে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, অর্থনীতির সংকট নিয়ে নীতিনির্ধারকরা কোনো ‘সিরিয়াস’ আলোচনাতেই যেতে চান না। তারা এক প্রকার ‘আত্মতুষ্টি’ নিয়ে বসে আছেন।
সমস্যার স্বীকৃতি না দিয়ে ‘আত্মতুষ্টি’ নিয়ে বসে থাকলে অনেক সময় সংকট গভীর হয়। আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অনেকাংশে দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বছর দুয়েক আগে যখন ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়, তখন অর্থনীতির ব্যবস্থাপকরা এক ধরনের আত্মতুষ্টিতে ছিলেন। বিদেশ থেকে বেসরকারি খাতে বেশি ঋণ আনার সুযোগের ফলে রিজার্ভ ফুলে-ফেঁপে ওঠে। করোনার কারণে সরকারও উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে তুলনামূলক বেশি ঋণ পায়। সেই রিজার্ভ এখন ২০ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে। আবার দীর্ঘদিন ধরে টাকা-ডলার বিনিময় হার কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়েছে। যখন বাধ্য হয়ে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হয়েছে, তখন একেবারে ডলারের দাম অনেক বেড়ে গেছে। এখন অর্থনীতিবিদরা যদি রিজার্ভ এবং বিনিময় হারের ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাহলে ‘তারা অর্থনীতি বোঝেন না’ বলা সংগত হবে?
আবার বিশ্ববাজার প্রসঙ্গ। পরিসংখ্যানের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। বিশ্বব্যাংক প্রতি তিন মাস পর ‘কমোডিটি মার্কেট আউটলুক’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ ছাড়া সংস্থাটি প্রতি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্যের হালনাগাদ পরিসংখ্যান দেয়। গত এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পণ্যমূল্য কমার প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে, ২০২৩ সালে সামগ্রিকভাবে ভোগ্যপণ্যের দাম কমবে গত বছরের চেয়ে ২১ শতাংশ। জ্বালানি পণ্যের দাম কমবে ২৬ শতাংশ।
গত মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের গড় দর ছিল ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার। গত জুলাই মাসে তা ৮০ ডলারে নেমেছে। সয়াবিন তেলের গড় দর ছিল প্রতি টন ১ হাজার ৬৬৭ ডলার। গত জুলাইয়ে যা ১ হাজার ১৩৬ ডলারে নেমেছে। একই সময় পাম অয়েলের দাম ১ হাজার ২৭৬ ডলার থেকে কমে ৮৭৯ ডলার হয়েছে। কাঁচাবাজারে বিক্রির জন্য আমরা আমদানি করি না এমন একটি পণ্য গরুর মাংস। গরুর মাংসের গড় দাম কেজিপ্রতি ৬ ডলার থেকে ৫ ডলারে নেমেছে। মুরগির মাংসের দামও আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। দাম বেড়েছে চিনির মতো হাতেগোনা দু’একটি পণ্যের। অথচ বাংলাদেশে হঠাৎ কোনো কোনো পণ্যের দাম এক লাফে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার নজির রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পেঁয়াজ ও রসুন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ভারত ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ হয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতিই যে একমাত্র সমস্যা, তা নয়। দেশে দীর্ঘদিন ধরে ডলার সংকট চলছে। অনিয়মের কারণে ব্যাংক খাত বারবার আলোচনায় আসছে। শেয়ারবাজারের অবস্থা খুবই করুণ। আর্থিক খাতের পুঞ্জীভূত অনিয়মের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণ দেখিয়ে ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের যেসব ছাড় দেওয়া হয়েছে, তার একটি বড় অংশের অপব্যবহার হয়েছে। ফলে খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। আইএমএফের মানদণ্ডে হিসাব করতে গিয়ে আর্থিক খাতের করুণ অবস্থা আরও প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট-২০২২ অনুযায়ী ব্যাংক খাতে পীড়িত বা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, যা এ খাতের ঋণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এ অবস্থা নিশ্চয় বিশ্ববাজারের কারণে হয়নি। সুতরাং বিশ্ববাজারের দোহাই দিয়ে অর্থনীতির সংকটের ব্যাখ্যা দেওয়ার আর অবকাশ নেই।
জাকির হোসেন, সহযোগী সম্পাদক, সমকাল
আই. কে. জে/