ছবি: সংগৃহীত
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, ভোরের কাগজের সাবেক সম্পাদক শ্যামল দত্ত, একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি শাহরিয়ার কবির, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাবেক সম্পাদক নঈম নিজামের পরিবার ও নিকট আত্মীয়েরা জানেন না তাদের বিরুদ্ধে এই পর্যন্ত মোট কতটি করে মামলা দায়ের হয়েছে। তারা বলছেন, গত এক বছরের মধ্যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মামলায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাই তারা মামলার সংখ্যা হিসাব রাখতে পারেননি। তবে এসব মামলা শেষ পর্যন্ত কোথায় গড়ায়, তা নিয়ে সাংবাদিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা উদ্বিগ্ন।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের মধ্যে দায়ের হওয়া দেশের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলার আইনি নথি ও প্রতিবেদন নিয়ে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংগঠন 'কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস' (সিপিজে) পর্যালোচনা করেছে। বৈশ্বিক এ সংগঠনের পর্যালোচনা বলছে, এফআইআর নথিভুক্ত হওয়ার অনেক পর সাংবাদিকদের নাম প্রায়ই বিভিন্ন মামলায় যুক্ত করা হয়। ফলে একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা বাড়তে থাকে। চলতি মে মাসে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গত বছরের বিক্ষোভের পর বাংলাদেশের ১৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। ঢালাওভাবে মামলায় সাংবাদিকদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলেও মনে করেন আইনবিশেষজ্ঞরা।
কারাবন্দী সাংবাদিক শ্যামল দত্তের মেয়ে শশী দত্ত বলেন, তার বাবার বিরুদ্ধে এখন কতগুলো মামলা চলছে, মোট কতটি মালা দায়ের হয়েছে, তাদের পরিবার এর হিসাব রাখতে পারেনি। তারা প্রায় ছয়টি হত্যা মামলার কথা জানেন, যেখানে শ্যামল দত্তের নাম আছে। এর বাইরে তার বাবা আর কোনো মামলার আসামি কী না, তা তাদের পরিবারের জানা নেই বলে তিনি জানান। মোজাম্মেল বাবুর পরিবার ১০টি মামলার কথা জানে। কারাগারে থাকা সাংবাদিক ফারজানা রুপা ও শাকিল আহমেদের পরিবার জানিয়েছে, তারা মোট পাঁচটি মামলার কোনো এফআইআর (ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট) পাননি, যেখানে একজন বা অন্য সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে তাদের কেউ জামিনের আবেদন করতে পারছেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অতীতের বিভিন্ন ও প্রায় সব সরকারের আমলে মামলা দায়ের হওয়া ও তাদের গ্রেপ্তার করার ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা এক ধরনের স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। তবে একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলের মতো এভাবে গণহারে মামলা হওয়া এবং মামলার ভুক্তভোগী সাংবাদিক কয়টি মামলার আসামি, তা না জানার ঘটনা দেশে আগে কখনো ঘটেনি।
তাদের মতে, সরকার এসব মামলার বিষয়ে মুখে যা-ই বলুক, সাবেক আওয়ামী লীগের সরকারের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান যে কঠোর, গত এক বছরে এর বিভিন্ন প্রমাণ পাওয়া গেছে। কোনো সাংবাদিক তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা না জানা ও তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা দেওয়া কোনো শুভ ইঙ্গিত বহন করে না। এটা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী।
তারা বলছেন, সাংবাদিকেরা কোনো অপরাধ করে থাকলে বা অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে যথাযথ ধারা অনুসরণে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। সাংবাদিকতার নামে কেউ বিগত সরকারের নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিলে একটি কমিটি গঠন করে তদন্ত ও অনুসন্ধান করা যেতে পারে। সেখানে প্রেস কাউন্সিল আইনে তার সাজা হতে পারে। সাংবাদিকদের অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রেও প্রেস কাউন্সিলের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রচলিত আইনে বিচার হতে পারে।
গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণে গত বছরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আট সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার। এই কমিটির কাজ গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণ করা ও সময়ে সময়ে মামলার বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা। তখন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন হয়রানিমূলক মামলা করা হচ্ছে। এসব মামলা পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ‘গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণ–সংক্রান্ত কমিটি’ গঠন করা হয়। সরকারের কমিটি গঠনের বিষয়টি প্রশংসিত হলেও এর কোনো কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না বলে অভিজ্ঞরা মনে করেন।
চলতি বছরের ৫ই মার্চ ফারজানা রুপা ঢাকার একটি জনাকীর্ণ আদালতে আইনজীবী ছাড়াই জামিনের আবেদন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ইতিমধ্যে আমার বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি একজন সাংবাদিক। আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি মামলাই যথেষ্ট।’ তার বক্তব্য থেকে পরিবারের সদস্যরা ধারণা করছেন, তার বিরুদ্ধে কমপক্ষে একডজন মামলা দায়ের হয়েছে।
তবে সিপিজের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, একাত্তর টেলিভিশনের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক ফারজানা রুপার বিরুদ্ধে ৯টি হত্যা মামলা রয়েছে। তার স্বামী, চ্যানেলটির সাবেক বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদের নামে রয়েছে আটটি হত্যা মামলা। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও পুলিশের মুখপাত্র এনামুল হক সাগরকে ই–মেইল করে সিপিজে। তবে তারা সাড়া দেননি বলে সিপিজের এক নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।
সিপিজে বলছে, 'আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কমপক্ষে ২৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত করছে। এই অভিযোগ সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।' গত বছরের ১৫ই অক্টোবর ঢাকার গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয় যে, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ''আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে জমা পড়া অভিযোগের বিষয়ে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ও ‘চুলচেরা’ বিশ্লেষণ করে প্রসিকিউশন টিম পদক্ষেপ নেবে। ট্রাইব্যুনালে সাংবাদিকদের বিচার হবে।''
তবে ১৭ই অক্টোবর রাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ‘আজকের পত্রিকা’ অনুষ্ঠানে দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, 'সাংবাদিকদের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হবে- এ ধরনের কোনো কথা তিনি বলেননি। তিনি বলেছেন, ট্রাইব্যুনালে সাংবাদিকদের বিচার হবে নাকি কার বিচার হবে- এটা সম্পূর্ণ প্রসিকিউশন টিমের ব্যাপার। এ বিষয়ে আমার বক্তব্য দেওয়ার স্কোপই (সুযোগ) নেই।
আওয়ামী লীগের সরকারের পতনের পর এক বছরে গণমাধ্যমের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে মূল্যায়ন তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এতে বলা হয়, অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ২৬৬ জনকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান–সংক্রান্ত হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। টিআইবি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি।
সিপিজের আঞ্চলিক পরিচালক বেহ লিহ ই সংগঠনটির ওয়েবসাইটে প্রচারিত এক নিবন্ধে বলেন, ‘চারজন (বাংলাদেশের) সাংবাদিককে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই এক বছর ধরে কারাগারে আটকে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রকৃত সংস্কার মানে অতীত থেকে বেরিয়ে আসা, এর অপব্যবহারের পুনরাবৃত্তি নয়। যেহেতু আগামী মাসগুলোতে দেশে নির্বাচন হতে চলেছে, তাই সব রাজনৈতিক দলকে সাংবাদিকদের খবর প্রকাশের অধিকারকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে।’
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল দৈনিক প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, গত এক বছরে ''বোধ হয় শতাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আমার জানা মতে, সাত-আটজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। গ্যারান্টি দিয়ে বলছি, মামলাগুলোর পেছনে সরকারের কোনো পক্ষের মদদ নেই। ধরেন, যারা সাধারণ ভুক্তভোগী, তারা যখন দেখেছেন মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, তখন কোনো সাংবাদিক যদি রক্তপিপাসু প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ‘আপনি যা করছেন ঠিক আছে। আমরা আপনার সঙ্গে আছি,’ সেটা কি মদদ নয়?''
ওই সাক্ষাৎকারে এক বছরে সরকারের সাফল্য–ব্যর্থতা, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার, ঢালাও মামলা, গ্রেপ্তার, মব–সন্ত্রাস, রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। তার সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব ৫ই আগস্ট, মঙ্গলবার পত্রিকাটির ছাপা সংস্করণে প্রকাশিত হয়।
খবরটি শেয়ার করুন