শংকর মৈত্র
বহুল আলোচিত জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারায় এখন এটা কিভাবে বাস্তবায়ন হতে পারে, এমন প্রশ্ন করেছিলাম সুপ্রিম কোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবীকে। প্রশ্ন শুনে তিনি হাসলেন। তারপর বললেন, কি আর করার আছে!
রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু একমত হতে পারেনি এখন একটা উপায় আছে, তিনশ' টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সই করে রাখা হোক। যে বা যারা ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসবে তারা সেটা বাস্তবায়ন করবে।
বিষয়টি তিনি মজা করেই বলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে এক লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যে আশা-প্রত্যাশা নিয়ে নয় মাস আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করা হলো তা বাস্তবায়ন নিয়ে এখন অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি আর ড. আলী রীয়াজকে সহসভাপতি করে সাত সদস্য বিশিষ্ট ঐকমত্য কমিশন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কার্যক্রম শুরু করে। ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নানা আলোচনা বৈঠক করে ৮৪টি সুপারিশ চূড়ান্ত করে। এই সুপারিশগুলোই হলো জুলাই সনদ।
১৭ই অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় প্রকাশ্যে সভা করে জুলাই সনদ স্বাক্ষর করে ২৫টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে প্রধান দল হিসেবে রয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান শক্তি ও নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক দল বা এনসিপি এই সনদে স্বাক্ষর করেনি।
৮৪টি সুপারিশের মধ্যে ৪৭টির মতো সুপারিশ রয়েছে যেগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আর ৩৭টি সুপারিশ নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন সম্ভব। সংবিধান সংশোধন করতে হলে যেহেতু নির্বাচিত সংসদ লাগবে, ফলে পরবর্তী সংসদ না হওয়া পর্যন্ত এগুলো বাস্তবায়নের কোনো সুযোগ নেই।
মূলত কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন হবে এটা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। দেশের মানুষ এই জুলাই সনদ চায় কি না এজন্য গণভোট আয়োজনের প্রশ্ন ওঠে।
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, যেদিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সেই দিনই আলাদা ব্যালটে গণভোট গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী এর সঙ্গে একমত হতে পারেনি। তারা সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠানের দাবি জানায়। নবগঠিত এনসিপিও আগে গণভোট অনুষ্ঠানের পক্ষে। অবশ্য অন্য যেসব দল সনদে স্বাক্ষর করেছে তাদের বক্তব্য কোনো গুরুত্ব পায়নি। ফলে মূল বিরোধটা হয়ে ওঠে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে।
এই অবস্থায় করণীয় ঠিক করতে ঐকমত্য কমিশন নিজেরাই উদ্যেগ নেয়। তারা নিজেরা আলোচনা বৈঠক করে গতকাল ২৮শে অক্টোবর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে একটা সুপারিশ দাখিল করে কমিশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের কাছে।
এই বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে এখন নিরুপায় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কে বলা হয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ নামে একটি আদেশ জারি করতে হবে। এই আদেশের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। এই গণভোট আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই একই সঙ্গে অথবা এর আগে যথোপযুক্ত সময়ে হতে পারে।
বাস্তবায়নের সুপারিশে আরো বলা হয়েছে, আগামী সংসদ গঠিত হওয়ার পর এটি দ্বৈত ভূমিকায় থাকবে। প্রথম ২৭০ দিন বা নয় মাস এটি হবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ। আরেকটি হবে নিয়মিত সংসদ। নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা দুইবার শপথ নেবেন।
একবার সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবে, আরেকবার আইনসভার সদস্য হিসেবে। প্রথম ২৭০ দিন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলবে। এই সময়ের মধ্যে যদি জুলাই সনদ অনুমোদন না হয়, তা হলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে সংযুক্ত হয়ে যাবে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞেরা এই বিষয়টি নিয়েই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন। তারা বলছেন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর একই সংসদে দুইবার শপথ নিতে হবে কেন? আর সংসদ যদি এটা গ্রহণ না করে তা হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে কেন? এমন অদ্ভুত নিয়ম পৃথিবীর কোনো দেশে আইনসভা কিংবা সংবিধানে কি আছে? এমন উদ্ভট চিন্তা এল কোথা থেকে?
বিএনপিও এই প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে। তারা বলেছে ঐকমত্য কমিশন অনৈক্যের সৃষ্টি করছে। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কমিশনের সঙ্গে তাদের যেসব বৈঠক হয়েছে এবং সেগুলোর আলোচনায় এসব বিষয় কখনো আলোচিত হয়নি।
বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট এবং বলেছে সংসদ নির্বাচনের দিনই আলাদা ব্যালটে গণভোট অনুষ্ঠিত হতে হবে। বিএনপির পক্ষ থেকে আরো গুরুতর অভিযোগ করে বলা হয়েছে, স্বাক্ষরিত সনদ বহির্ভূত অনেক পরামর্শ বা সুপারিশ সনদ বাস্তবায়নের খসড়ায় যুক্ত করা হয়েছে। তাদের নোট অব ডিসেন্টগুলোও রাখা হয়নি।
অন্যদিকে জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জুলাই সনদ দেশবাসী চায় কী না এটার জন্য নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে। নির্বাচন কমিশনে গিয়েও তারা এ দাবি জানিয়ে এসেছে। জামায়াত মনে করে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট অনুষ্ঠিত হলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে।
ফলে সনদ তৈরি হলেও বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে এখন স্পষ্ট বিরোধে রূপ নেবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। বিশেষ করে গণভোটের ব্যাপারে বিএনপি ও জামায়াতের অবস্থান বিপরীত মেরুতে।
আর সংবিধান সংশোধন পরিষদ গঠন, সংসদ সদস্যদের দুইবার শপথ নেওয়া, ২৭০ দিনের মধ্যে অনুমোদন না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে সংযুক্ত হওয়ার সুপারিশকে আজগুবি চিন্তাভাবনা বলছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞেরা।
তারা বলছেন, ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক, আলোচনা করে জুলাই সনদের ৮৪টি সুপারিশ চূড়ান্ত করেছে এটা ভালো কথা। যদিও এনসিপিসহ অনেক দল এতে স্বাক্ষর করেনি। তারপরও স্বাক্ষরিত এই সুপারিশগুলোর মধ্যে যেগুলো নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব সেগুলো রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে দ্রুতই বাস্তবায়ন করা যায়। এ ক্ষেত্রে কালক্ষেপণের দরকার কি?
আর যেগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে সেগুলো সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়াই উচিত। সংসদে এগুলো নিয়ে আরো আলোচনা পর্যালোচনা হোক। তা না করে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া আর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে এমন বিধান করা গণতন্ত্র হতে পারে না।
নির্বাচিত সংসদের ওপর অনির্বাচিত সরকার কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। এতে রাষ্ট্রযন্ত্র বিকল হয়ে যাবে। সংসদ সার্বভৌম। সংবিধান রাস্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান সংশোধন করতে হলে সংসদের মাধ্যমেই যেতে হবে। অটোপাসের মতো সংবিধান সংশোধন কিংবা কোনো কিছু যুক্ত করা বিধানও নেই, সুযোগও নেই।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
খবরটি শেয়ার করুন 
                      
                                                
                                             
                                         
                                                         
                                         
                                                         
                                                         
                                                         
                                                         
                                             
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                                     
                                            