শাহ পাহলভীর গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান পারভেজ সাবেতি। ছবি: দ্য গার্ডিয়ানের সৌজন্যে
ইরানের সাবেক শাসক শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর কুখ্যাত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার নাম ছিল সাভাক। ভিন্নমতাবলম্বী ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের ধরে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন করাই ছিল এই সংস্থার প্রধান কাজ।
এই সংস্থার প্রধান পারভেজ সাবেতি (৮৯) বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের উইন্ডারমেরে একটি অভিজাত এলাকায় বসবাস করেন। পিটার ছদ্মনামে এত দিন নির্ঝঞ্ঝাটেই কাটিয়েছেন তিনি। আপাতদৃষ্টিতে শান্তশিষ্ট এক অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ হিসেবেই মানুষ তাকে চিনত। কিন্তু সম্প্রতি পরিচয় ফাঁস হয়ে গেছে। অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য যুক্তরাষ্ট্রেই আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন তিনি।
প্রায় ৪৫ বছর ধরে নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে পেরেছিলেন সাবেতি। তবে সম্প্রতি সাবেক তিন রাজনৈতিক বন্দী তার বিরুদ্ধে ২২৫ মিলিয়ন ডলারের (প্রায় ২,৪০০ কোটি টাকা) ক্ষতিপূরণ মামলা করেছেন। খবর দ্য গার্ডিয়ানের।
পারভেজ সাবেতি শাহের শাসনামলে সাভাক-এর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক ছিলেন। তাকে শাহের শাসনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এবং ভয়ংকর পুরুষদের একজন হিসেবে গণ্য করা হতো। ১৯৭৮ সালে লেখা মার্কিন সিআইএর একটি গোপন নথিতেও সাবেতিকে শাহের একান্ত অনুগত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে মামলার বিবরণের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, দেশজুড়ে বিরোধীদের গ্রেপ্তার, জিজ্ঞাসাবাদ এবং বিচারের ক্ষমতা ছিল সাবেতির হাতে। সাভাক প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৭৯ সালে বিলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষকে আটক ও নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে শত শত ব্যক্তিকে হত্যা করেছে এই সাভাক।
মামলার বাদী তিন ব্যক্তি, যাদের বয়স এখন ৬৮ থেকে ৮৫ বছরের মধ্যে, তারা বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস করেন। তারা অভিযোগ করেছেন, সাবেতির সরাসরি নির্দেশে তেহরানের কারাগারে তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছিল। অত্যাচারের মধ্যে ছিল: ধর্ষণ, বৈদ্যুতিক শক, পানিতে চুবানো ও হাত-পায়ের নখ উপড়ে ফেলা।
বাদীপক্ষের অভিযোগ অনুসারে, সাভাক-এর কারাগারে ‘অ্যাপোলো’ নামে একটি বিশেষ বৈদ্যুতিক চেয়ারের মতো যন্ত্র ব্যবহার করা হতো। এ যন্ত্রটিতে একটি ধাতব হেলমেট ছিল। এই হেলমেট পরার কারণে নির্যাতিত ব্যক্তিরা যখন যন্ত্রণায় চিৎকার করতেন, সেই চিৎকার বহুগুণে বর্ধিত হয়ে নিজেদের কানেই ফিরে আসত। ফলে যন্ত্রণায় চিৎকার করলে যন্ত্রণা আরও বেড়ে যেত।
সাবেতির আইনজীবীরা যুক্তি দিয়ে মামলাটি খারিজ করার আবেদন করেছেন। তাদের দাবি, এই অভিযোগ ‘দায়ের করার সময়সীমা’ পার হয়ে গেছে। কিন্তু গত ১২ই আগস্ট, ফ্লোরিডার কেন্দ্রীয় ফেডারেল জেলা আদালতের বিচারক গ্রেগরি প্রেসনেল তাদের আবেদন আংশিকভাবে খারিজ করে দেন। বিচারক রায় দেন, নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা আইনের অধীনে করা অভিযোগ আমলে নেওয়া হবে।
যদিও আদালতের নির্দেশে রাজ্যের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আইনি অভিযোগগুলো খারিজ করা হয়েছে। তবে এখন নির্যাতনের অভিযোগটি দায়েরের সময়সীমার বাইরে কি না, তা নির্ধারণের জন্য উভয় পক্ষকে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হবে। যদি অভিযোগটি দায়ের করার সময়সীমার মধ্যে বলে প্রমাণিত হয়, তবে আগামী বছরই এর বিচার শুরু হতে পারে।
সাবেতি এর আগে দাবি করেছিলেন, তিনি ‘সর্বদা নির্যাতনের বিরোধী ছিলেন’ এবং সাভাক কখনো বন্দীদের নির্যাতন করত না।
পারভেজ সাবেতি ও তার স্ত্রী নাসরিন (৭৫) ১৯৭৮ সালে তেহরান থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। ফাঁস হওয়া স্টেট ডিপার্টমেন্টের নথি অনুযায়ী, তারা ইরান থেকে ২০ মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ স্থানান্তর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর তারা নাম পরিবর্তন করে যথাক্রমে পিটার ও ন্যান্সি রাখেন।
এই ছদ্মনামে সাবেতি ফ্লোরিডায় একটি রিয়েল এস্টেট ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ফ্লোরিডার অরেঞ্জ কাউন্টিতে ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বিলাসবহুল উইন্ডারমের ম্যানশনসহ কমপক্ষে আটটি সম্পত্তির মালিক হন।
মামলার আরজিতে দাবি করা হয়েছে, ৪৫ বছর ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা সাবেতির পরিচয় প্রকাশ্যে আসে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
তার এক মেয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে ইরান সরকারের বিরুদ্ধে একটি র্যালিতে বাবার ছবি টুইট করেন, এতেই ফাঁস হয়ে যায় পরিচয়। বাদীপক্ষ দাবি করেছে, এই ঘটনাটির ফলেই তারা সাবেতির অবস্থান চিহ্নিত করতে এবং মামলা করতে সক্ষম হন।
বর্তমানে সাবেতি সাবেক শাহের পুত্র রেজা পাহলভীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করছেন বলে জানা যায়।
বাদীপক্ষের আইনজীবী সারা কোলন আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি তার মক্কেলদের নাম গোপন রাখার আবেদন মঞ্জুর করায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। কারণ মামলা দায়ের করার পর থেকেই তাদের হত্যার হুমকি এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের পক্ষে কাজ করা ‘ইরানি কালেক্টিভ ফর জাস্টিস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টেবিলিটি’ নামের একটি সংস্থা জানিয়েছে, সাবেতির এই মামলা শাহের শাসন এবং তার পরবর্তী ইসলামি সরকারের অধীনে ইরানে চলে আসা ‘হিংসার চক্র’ বন্ধ করতে সাহায্য করবে।
সংস্থাটির মুখপাত্র বলেন, ‘বার্তাটি সহজ এবং স্পষ্ট হওয়া উচিত: সমস্ত ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার পাওয়ার যোগ্য এবং নির্যাতন ও নিপীড়নে জড়িত প্রত্যেককেই জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।’
জে.এস/
খবরটি শেয়ার করুন