ছবি: সংগৃহীত
কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহার সরকারের কোনো পদে না থাকলেও তাকে অন্তর্বর্তী সরকারে ‘অন্যতম প্রভাবক’ হিসেবে মনে করেন অনেকে। তার বক্তব্য ও পরামর্শে সরকারের নীতিনির্ধারকরা সাধারণত গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তার স্ত্রী ফরিদা আখতার অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা। সম্প্রতি ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দু’জনের দেওয়া বক্তব্য কেন্দ্র করে তোলপাড় শুরু হয়েছে নেট দুনিয়ায়।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যারা সরকারের প্রতিশ্রুত সময় থেকে পেছাতে চায়, বর্তমান সরকারের মেয়াদ যারা দীর্ঘায়িত করতে চায়, তাদেরই বক্তব্যের ‘প্রতিধ্বনি’ ফরহাদ মজহার ও ফরিদা আখতার করেছেন কী না, এমন প্রশ্নও তুলেছেন নেটিজেনরা। তাদের বক্তব্যকে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন বিলম্বিত করার ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখছেন অনেকে।
এর আগে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল কয়েকদিন নেটিজেনদের মধ্যে আলোচনায় ছিলেন তাদের স্ত্রীদের কেন্দ্র করে। ফারুকীর স্ত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে সুবিধাভোগী ও আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ অভিনেত্রী ছিলেন বলে নেটিজেনরা অভিযোগ করেন। ওই সরকারের আমলে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীভিত্তিক সিনেমায় তার স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিশা।
আসিফ নজরুলের স্ত্রী শীলা আহমেদ (প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মেয়ে) সম্পর্কে দেশ থেকে নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্প্রতি অযাচিত সমালোচনামূলক একটি পোস্ট দেন ফেসবুকে। উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল এর জবাবও দেন নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কয়েকদিন নেটিজেনদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলে।
তবে ফরিদা আখতার ও ফরহাদ মজহার দম্পতিকে নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের বিস্তৃতি অনেক ব্যাপক। রাজনীতির মাঠ থেকে শুরু করে টিভি চ্যানেলের টক-শো, চায়ের আড্ডা থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের বক্তব্য ‘ভাইরাল’ (আলোচিত)। কলামলেখক ফরহাদ মজহার বিভিন্ন সময় নানাভাবে আলোচনায় থাকেন। ফরিদা আখতার কূটতর্ক সবসময় এড়িয়ে চলেন। প্রথমবারের মতো এ দম্পতি বক্তব্যের কারণে একসঙ্গে ‘ভাইরাল’ বলে মনে করা হচ্ছে।
তারা কেন তা বলেছেন, এর আসল উদ্দেশ্য কী- এ নিয়ে দেশের অন্যতম প্রধান বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলে আলোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে। তারা আক্রমণ ও বাক্যবাণেরও শিকার হচ্ছেন। তাদের বক্তব্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও। তবে কোনো কোনো দলের নেতারা তাদের বক্তব্যে আমল না দিয়ে আগামী নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথায় আস্থা রাখতে চাচ্ছেন। ড. ইউনূস গত শনিবারও (১২ই এপ্রিল) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দুই সদস্যের সঙ্গে বৈঠকে চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্য নিয়ে সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ দেন।
বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছে। এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের মনোভাবে দলগুলো আশ্বস্তও ছিল। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে বিভিন্ন মহলের প্রচার ও জনমত গঠনের চেষ্টা তাদের ভাবনা বদলে দিয়েছে। নির্বাচন 'বিলম্বিত' হওয়ার সংশয় দেখা দিয়েছে বিএনপিতে। এ সংশয় কাটাতে দলটি আগামী ১৬ই এপ্রিল বৈঠকে বসবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূসের সঙ্গে।
ঠিক এমন রাজনৈতিক বাস্তবতায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার গত ১২ই এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে দাবি করেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতা এ সরকারকে নির্বাচিত করেছে ও গঠন করেছে। কাজেই এ সরকারের দায়িত্ব হলো ছাত্র-জনতার চাহিদা মেটানো। আমরা অনির্বাচিত এ কথা কে বললো?’
একই অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, ‘ভোট দিয়ে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয় না, ভোটে ক্ষমতায় আসে লুটেরা শ্রেণি।’
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টার ওই বক্তব্যের সমালোচনা করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ ইতিমধ্যে বলেছেন, ‘আমাদের ফরিদা আপা একজন উপদেষ্টা... আমার সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক, সে জন্য আমি সমালোচনা কম করতে চাই। বললেন, উনারা নাকি নির্বাচিত হয়েছেন। কীভাবে? গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে উনাদের নির্বাচিত করেছে জনগণ? তাহলে এ দেশে নির্বাচন কমিশন আছে কেন?’
এ প্রসঙ্গে সালাহ উদ্দিন আহমদ আরও বলেন, ‘যদি রাস্তার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন হয়, সেটা অবশ্যই এ দেশের মানুষের কামনা। কিন্তু একটা নির্বাচিত সরকারের বিকল্প তো আপনারা হতে পারেন না। আপনারা অবশ্যই অনির্বাচিত। সেটা প্রতিদিন আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে।’
এ সময় কবি–চিন্তক ফরহাদ মজহারের একটি বক্তব্যেরও সমালোচনা করেন সালাহ উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘উনার (ফরিদা আখতার) স্বামী আমাদের ভাই ফরহাদ মজহার সাহেব দুই–তিন দিন আগে বক্তব্য দিয়েছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে নাকি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না। শুধু লুটেরাদের একটা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়। কী আর বলব!’
একই অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, 'উপদেষ্টাদের কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, এটাও একটা নির্বাচন। একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে উনি ক্ষমতায় এসেছেন।’
এ বিশেষ পরিস্থিতি কত দিন স্থায়ী হবে, সেই প্রশ্ন তুলে ডাকসুর সাবেক ভিপি মান্না বলেন, ‘আইয়ুব খানও (পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক) একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন। এক-এগারোর যারা কুশীলব, তারাও বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতি থাকেনি।'
এ প্রসঙ্গে মান্না আরও বলেন, ‘আজকে যে পরিস্থিতিকে বিশেষ মনে হচ্ছে, তিন মাস পরে যখন সেই পরিস্থিতি বদলে যাবে, তখন বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল প্রাইজ বিজয়ী (প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস) যদি সারাদেশের মানুষের কাছে সমালোচিত হন, সেটা কি দেশের জন্য কল্যাণকর হবে?’
প্রসঙ্গত, উপদেষ্টা ফরিদা আখতার অধিকারকর্মী হিসেবে সুপরিচিত। তিনি ১৯৮০-এর দশক থেকে নারী অধিকার নিয়ে কাজ শুরু করেন। উন্নয়ন বিতর্কের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ) নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক তিনি।
ফরিদা আখতার নারী গ্রন্থ প্রবর্তনা নামে নারীবিষয়ক একটি প্রকাশনা সংস্থার প্রধান। ১৯৯৫ সালে দিনাজপুরে ইয়াসমিন আক্তার নামে ১৪ বছরের এক কিশোরী ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়। এ ঘটনায় সৃষ্টি হওয়া ব্যাপক প্রতিবাদে অংশ নেন ফরিদা আখতার। পুলিশের কয়েক সদস্য ওই কিশোরীকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছিলেন। সেই সময় ওই ঘটনা দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করে। ফরিদা আখতারের তখনের ভূমিকার কথা মানুষ আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
এইচ.এস/