ছবি: সংগৃহীত
অনেক ভারতীয় সুস্বাস্থ্যের আশায় পান করেন নিজের মূত্র। আবার অনেকে গো-মূত্রও পান করেন। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই দাবি করতেন, প্রতিদিন এক গ্লাস করে নিজের মূত্রপান অনেক রোগ সারিয়ে তোলে ও দীর্ঘজীবন লাভে সহায়তা করে।
শুধু মোরারজি দেশাইয়ের মতো ভারতীয়রাই নন, পশ্চিমা দুনিয়াতেও নিজের মূত্রপানের বিষয়টি বেশ পরিচিত। জনপ্রিয় টিভি তারকা বেয়ার গ্রিলস বলেন, তিনি বেঁচে থাকার জন্য মূত্রপান করেন। পাশাপাশি, তিনি তার রিয়্যালিটি শো’র প্রতিযোগীদেরও এটি শেখান। মেক্সিকোর বক্সার হুয়ান ম্যানুয়েল মার্কেজ ২০০৯ সালে ফ্লয়েড মেওয়েদারের সঙ্গে লড়াইয়ের প্রশিক্ষণের সময় এ থেরাপি অনুশীলন করেছিলেন। তবে মার্কেজ হেরে গিয়েছিলেন।
সম্প্রতি ভারতের জনপ্রিয় অভিনেতা পরেশ রাওয়ালও মূত্রপান করে আলোচনায় এসেছেন। তিনি সম্প্রতি পায়ের চোট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন বলিউডের জনপ্রিয় নায়ক অজয় দেবগনের বাবা বিরু দেবগন। তিনি পরেশ রাওয়ালকে মূত্রপানের পরামর্শ দেন। এসব তারকা যে থেরাপি অনুশীলন করেন—তার নাম ইউরোফাজিয়া, যা মূত্র থেরাপি নামেও পরিচিত। এটি হলো প্রস্রাব পানের অভ্যাস। নিজের, অন্যের বা পশুর প্রস্রাব যাই হোক না কেন, মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে ওষুধ হিসেবে এটি পান করে আসছেন।
ব্রিটেনের কিংস্টোন ইউনিভার্সিটির ফার্মাসি প্র্যাকটিস বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক দীপা কামদার এ বিষয়ে বিজ্ঞান বিষয়ক সংবাদমাধ্যম দ্য কনভারসেশনে লিখেছেন। তিনি জানান, মূত্র থেরাপির উপকারিতা সম্পর্কে বেশিরভাগ দাবিই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা প্রাচীন লেখার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, যার কোনো জোরালো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
প্রস্রাব পানে বেশ কিছু স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে, যার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে হাঁপানি, অ্যালার্জি, বদহজম, ত্বক কুঁচকে যাওয়া এবং এমনকি ক্যানসারের চিকিৎসায়ও প্রস্রাব ব্যবহৃত হতো। রোমান কবি ক্যাটুলাস বিশ্বাস করতেন, প্রস্রাব দাঁত সাদা করতে সাহায্য করে—সম্ভবত এর অ্যামোনিয়া উপাদানের কারণে।
ডায়াবেটিস নির্ণয়ের একটি প্রাথমিক পরীক্ষা হিসেবে ডাক্তাররা প্রস্রাবের স্বাদ নিতেন এটি কতটা মিষ্টি তা জানার জন্য। এখন অবশ্য প্রস্রাবে গ্লুকোজ পরীক্ষার জন্য ইউরিন টেস্ট স্ট্রিপ ব্যবহার করা হয়। ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ নেচারোপ্যাথ জন ডব্লিউ আর্মস্ট্রং ‘দ্য ওয়াটার অব লাইফ: এ ট্রিটিজ অন ইউরিন থেরাপি’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। তিনি দাবি করেন, নিজের প্রস্রাব পান করলে এবং ত্বকে মালিশ করলে বড় ধরনের অসুস্থতাও নিরাময় হতে পারে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের পরও প্রস্রাব পানকারী তারকাদের মতো অনেকের মাঝেই আজও এ অভ্যাস প্রচলিত। নাইজেরিয়ায় শিশুদের খিঁচুনির ঘরোয়া চিকিৎসা হিসেবে প্রস্রাব ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে। চায়না ইউরিন থেরাপি অ্যাসোসিয়েশন দাবি করেছে, প্রস্রাব পান করা হলে এবং তা দিয়ে ত্বক ধৌত করা হলে কোষ্ঠকাঠিন্য ও ত্বকের ঘা সারাতে পারে।
শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে দেওয়ার জন্য প্রস্রাব তৈরি হয়। এর বেশির ভাগটাই পানি (প্রায় ৯৫ শতাংশ) এবং কয়েকটি বর্জ্য পদার্থ—যার মধ্যে যকৃতে প্রোটিন ভাঙার পর তৈরি হওয়া ইউরিয়া (২ শতাংশ), মাংসপেশির শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ার পর অবশিষ্ট থাকা ক্রিয়েটিনিন এবং লবণ। এখন প্রশ্ন হলো—প্রস্রাব যদি কেবল বর্জ্যই হয়, তাহলে এটি পান করা উপকারী হতে পারে কীভাবে?
কিডনি ছাঁকনির মতো কাজ করে—কেবল বিষাক্ত পদার্থই নয়, শরীরের অপ্রয়োজনীয় সবকিছুই এটি বের করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, শরীরে অতিরিক্ত ভিটামিন যা প্রয়োজন নেই তা প্রস্রাবে পাওয়া যায়। প্রস্রাব পান করার অর্থ হলো—এই ভিটামিন এবং খনিজগুলো নষ্ট না হয়ে পুনর্ব্যবহার হচ্ছে। এ ছাড়া প্রস্রাবে পাওয়া অন্যান্য হরমোন, প্রোটিন এবং অ্যান্টিবডির ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য।
তবে এক গ্লাস প্রস্রাবে এ পদার্থগুলোর পরিমাণ উপকারী হওয়ার মতো যথেষ্ট নয়, বরং এর চেয়ে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট বেশি কার্যকর হতে পারে।
মূত্র থেরাপির কিছু সমর্থক বিশ্বাস করেন, এটি অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধ করতে এবং অটোইমিউন (স্ব-রোগপ্রতিরোধ) অবস্থা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। প্রস্রাবে থাকা অ্যান্টিবডিগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে বলে মনে করা হয়।
প্রস্রাব পানের দাবি করা অন্যান্য আধুনিক ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে শরীর পরিষ্কার ও ডিটক্সিফিকেশন। কিছু লোক দাবি করেছেন, নিয়মিত রিসাইকেল করা প্রস্রাব পান করলে প্রস্রাব এবং রক্ত আরও পরিষ্কার হয়, বিষাক্ত পদার্থ দূর হয় এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নত হয়। তবে দাবিগুলোর স্বপক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। কিছু সামাজিক মাধ্যম ইনফ্লুয়েন্সার দাবি করেন, প্রস্রাবের নিরাময় ক্ষমতা আছে এবং এটি পান করলে বা ত্বকে লাগালে ব্রণ ও সংক্রমণের মতো ত্বকের সমস্যা ভালো হয়।
তবে প্রস্রাবে ইউরিয়া থাকে। আর প্রায়শই ময়েশ্চারাইজার হিসেবে ত্বকের পরিচর্যা পণ্যগুলোতে ইউরিয়া যোগ করা হয়। কিন্তু প্রস্রাবে ইউরিয়ার ঘনত্ব এত বেশি হওয়ার সম্ভাবনা নেই যে এটি কার্যকর হবে। প্রস্রাবে ডিহাইড্রোপিয়ান্ড্রোস্টেরনও থাকে। এটি শরীরের তৈরি একটি স্টেরয়েড হরমোন যা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে যায়। এটিকে অ্যান্টি-এজিং উপাদান হিসেবে বাজারজাত করা হয়েছে। তবে এর কার্যকারিতা প্রদর্শনের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য নেই।
মূত্র থেরাপির কিছু সমর্থক বিশ্বাস করেন, প্রস্রাব জীবাণুমুক্ত। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, প্রস্রাবে প্রাকৃতিকভাবেই কম মাত্রায় ব্যাকটেরিয়া থাকে এবং প্রস্রাব শরীর থেকে বের হওয়ার সময় ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আরও দূষিত হতে পারে। তাই প্রস্রাব পান করলে অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়া এবং বিষাক্ত পদার্থ প্রবেশ করতে পারে এবং পাকস্থলী সংক্রমণের মতো আরও অসুস্থতার কারণ হতে পারে।
মূলধারার চিকিৎসক সমাজ মূত্র থেরাপিকে সমর্থন করে না। কারণ, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অল্প পরিমাণে প্রস্রাব পান করা সম্ভবত ক্ষতিকর নয়। তবে সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্য সুবিধার জন্য, বৈজ্ঞানিক প্রমাণ রয়েছে এমন অন্যান্য থেরাপি গ্রহণ করাই ভালো।
এইচ.এস/