ছবি : সংগৃহীত
রবিউল হক
বাউল গান হচ্ছে এ দেশের সংগীত ভান্ডারের একটি বিশিষ্ট ধারা। এ দেশের মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনদর্শন ফুটে ওঠে বাউল গানে। এছাড়া বাউল গানে সাম্য ও মানবতার জয়গান করা হয়ে থাকে। প্রাচীন বৌদ্ধ সহজিয়া ও সুফিবাদের এক মিশ্রিত চিন্তাধারার ফসল হচ্ছে বাউল গান। বাঙালির আদি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য চর্যাপদ বিশ্লেষণে দেখা যায় এর পদকর্তাগণ ছিল একেকজন উচ্চমার্গীয় ভাবসাধক। যাদের আদর্শ বাউল ধারার মধ্যে লক্ষ করা যায়।
জাতিংঘের শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা ইউনেস্কোর সদর দপ্তর প্যারিস থেকে ২০০৫ সালের ২৭শে নভেম্বর এক বিবৃতির মাধ্যমে এদেশের বাউল গানকে মানবতার ধারক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বাংলাদেশের বাউল গানকে ইউনেস্কো অসাধারণ সৃষ্টি হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। যার ফলে এদেশে মানুষের জীবনাদর্শের এক উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। চর্যা পদকর্তাগণ যদি ভাবসাধক হয়ে থাকেন আর বর্তমান বাউল ধারার যোগ্য পূর্বসূরি হিসেবে যদি তাদের মনে করা হয়েই থাকে তবে বর্তমান কালের শিক্ষা, সাহিত্য, দর্শন, শিল্প, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতির জয়ঢাক বাউল-সাধকদের গানের মাধ্যমেই ছড়িয়েছে আরো প্রায় দেড় দুই হাজার বছর আগে বাংলার মাটিতে। আজকের মানবিক বিশ্ব গড়ার যে উন্মাদনা আমরা লক্ষ করি বহুকাল আগে এদেশের সাধকগণ এর বীজ বপন করে গেছেন। বর্তমানে এদশের বাউল গান নিয়ে দেশ ও বিদেশে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। বাংলাদেশের বাউল গান নিয়ে বর্তমানে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে। অধরা এই সম্পদ এদেশের মানুষের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা প্রকাশের অন্যতম বাহন হিসেবে কাজ করছে। বিশ্ব দরবারে বাউল গানের মর্যাদা, কদর বহুগুণ বেড়ে গেছে।
আরো পড়ুন : বাংলাদেশে যত উৎসব ও পার্বণ
বাউল দর্শনে মূলত নিজ দেহের মধ্যে স্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। বাউলরা সবসময় দেহের ভেতরে বাস করা সেই মনের মানুষ বা পরমাত্মার সন্ধান করেন। যাকে কখনো কখনো অচীন পাখি, কখনো বা সহজ মানুষ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। বাউলের আসল সাধনা এখানেই। ভজন সাধনের রস আস্বাদন করতে গেলে বাউল গানের বিকল্প নেই। অধরাকে ধরতে পারা আর অদেখাকে দেখতে পারাই বাউল সাধনা মার্গের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচ্য। পার্থিব চাওয়া পাওয়ার যে প্রবণতা তা থেকে নিজেকে মুক্ত করেই বাউলগণ ভাবসাধনায় নিমগ্ন থাকেন। মানুষ ভজার মাধ্যমে স্রষ্টার সৃষ্টির রহস্য উদঘাটনে মত্ত থাকেন বাউল ফকিরগণ। মানবিক বিশ্ব গড়ার উদাত্ত আহবান ও জয়ধ্বনি আমরা বাউলের কণ্ঠে সদা শুনতে পাই। তাইতো এদেশের অন্যতম বাউল সাধক শাহ আবদুল করিম কোনও এক সাক্ষাৎকারে শিল্পী ও গবেষক স্বর্গীয় কালীকা প্রসাদকে যথার্থই বলেছিলেন, “আমি স্বপ্ন দেখি এই দেশটা একদিন বাউলের হবে”।
বাউল শিরোমনি মহাত্মা ফকির লালন সাঁই মানবতার মূর্ত প্রতীক। ফকির লালন গানের মধ্যদিয়ে যে দর্শনের দীপশিখা প্রজ্জ্বলন করেছিলেন তা মানবিক বিশ্ব গঠনে আদর্শ স্বরূপ। আমৃত্যু তিনি মানবতার জয়গান করে গেছেন। তিনি ছিলেন সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের পূজারী।
রবিউল হক, লোক গবেষক ও শিল্পী
এস/ আই.কে.জে/