ছবি: সংগৃহীত
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তির দিন ৫ই আগস্ট, মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দলের নেতা, শহীদ পরিবারের সদস্য, জুলাই আহত যোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, কূটনৈতিক, তিন বাহিনীর প্রধান ও উপদেষ্টারা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন না জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পাঁচ শীর্ষ নেতা। সেদিন তারা কক্সবাজার সফরে গিয়েছিলেন। তাদের রহস্যজনক কক্সবাজার সফর নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই তাদের সেখানে যাওয়া, বিলাসবহুল রিসোর্টে ওঠা, পরদিন আকস্মিক হোটেল পরিবর্তন— সব মিলিয়ে পুরো সফরকে ঘিরে জোরালো হয়েছে রাজনৈতিক জল্পনা-কল্পনা।
দৈনিক যুগান্তর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ডিজিএফআই ও এনএসআইসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা গত দুইদিন ধরে নেতাদের (এনসিপির) প্রতিটি গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখছেন। শুধু নজরদারিই নয়—গোপন বৈঠকের গুজব, বিদেশি কূটনীতিকের নাম ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া নানা তথ্য, আর কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ- সব মিলে সফরটিকে ঘিরে উঠেছে এক ধোঁয়াশা ও কৌতূহল। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে এনসিপির নেতারা ঠাণ্ডা মাথায় একে অন্যকে আক্রমণ করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্না নিজের ইউটিউব চ্যানেল 'মানচিত্রে' প্রকাশিত এক ভিডিওতে এসব বিষয়ে কথা বলেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার (৭ই আগস্ট) আপলোড করা ভিডিওতে তিনি বলছেন, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে একই সঙ্গে কক্সবাজার সফরকে কেন্দ্র করে তাদের একাংশের (এনসিপির পাঁচ নেতা) ওপর গোয়েন্দা নজরদারি চলছে। সেই জায়গা থেকে আমাদের মনে নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠছে। কোন পক্ষ রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করছে, কোন পক্ষ বিপক্ষে? সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কারা, যারা হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলমের ওপর গোয়েন্দা নজরদারির নির্দেশ দিয়েছেন?
দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে এনসিপির শীর্ষ পাঁচ নেতাকে কক্সবাজার ঘুরতে যাওয়ার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। কেন দলের কাউকে অবহিত না করে তারা কক্সবাজার ঘুরতে গেলেন? এ বিষয়ে মঞ্জুরুল আলম পান্না বলেন, এর উত্তরে হাসনাত আব্দুল্লাহ বা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর মতো শীর্ষ নেতারা যে জবাব দিয়েছেন, তা খুবই হাস্যকর এবং পরস্পরবিরোধী।
তিনি বলেন, ‘চিঠিতে বলা হয়েছিল দলের আহ্বায়ক বা সদস্য সচিব বা দলীয় পর্ষদ তারা কেউ জানত না এই পাঁচজন কোথায় যাচ্ছেন। তাই তাদের সশরীরে উপস্থিত হয়ে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বা দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেনের সামনে ব্যাখ্যা দিতে হবে। জবাবে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলছেন, ৫ই আগস্ট আমার কোনো পূর্বনির্ধারিত রাষ্ট্রীয় বা সাংগঠনিক কর্মসূচি ছিল না। দল থেকেও আমাকে এ সংক্রান্ত কোনো দায়িত্ব বা কর্মপরিকল্পনা জানানো হয়নি। ৪ঠা আগস্ট রাতে দলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ তার কোচিং অফিসের সহকর্মীর ফোন ব্যবহার করে আমাকে জানায়—সে তার স্কুল বন্ধুদের সঙ্গে দুইদিনের জন্য ঘুরতে যাবে। আমি তাকে আহ্বায়ককে জানাতে বলি, সে বলে বিষয়টি জানাবে এবং আমাকেও জানাতে বলে।’
তিনি আরো বলেন, ‘নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী লেখেন, ৪ঠা আগস্ট রাতে পার্টি অফিসে আমি আহ্বায়কের সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি জানাই। একই রাতে আমি সদস্য সচিবের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করি এবং জানতে পারি—রাষ্ট্রীয় প্রোগ্রামে দল থেকে তিনজন প্রতিনিধি যাচ্ছেন এবং সেখানে আমার কোনো কাজ নাই। আমি কোনো দায়িত্বে না থাকায় এবং ব্যক্তিগত প্রয়োজন ও মানসিক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।’
মঞ্জুরুল আলম পান্না বলেন, ‘চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, এই ঘোরার লক্ষ্য ছিল রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে একান্তে চিন্তা-ভাবনা করা। সাগরের পাড়ে বসে আমি গভীরভাবে ভাবতে চেয়েছি—গণ-অভ্যুত্থান, নাগরিক কমিটি, নাগরিক পার্টির কাঠামো, ভবিষ্যৎ গণপরিষদ এবং একটি নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধানের রূপরেখা নিয়ে।’
সাংবাদিক পান্না মন্তব্য করেন, এগুলো নিয়ে ভাবতে সাগর পাড়ে যেতে হয়, তা আমরা শিখলাম। কিন্তু এর আগে সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছিলেন, আমরা একটু ঘুরতে এসেছি। মাসব্যাপী পদযাত্রা ছিল, ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম তাই ঘুরতে এসেছি। কিন্তু নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলছেন, দলের ভবিষ্যতের কর্ম-পরিকল্পনা এবং রাষ্ট্রকে নিয়ে সাগড় পাড়ে গেছেন চিন্তা করতে। তিনি বললেন যে, দলের শীর্ষ নেতাদের জানানো হয়েছে। আর শোকজের চিঠিতে বলা হয়, তারা কেউ কিছু জানায়নি কেন?
পান্না আরো বলেন, হাসনাত আব্দুল্লাহ তার চিঠিতে বলেছেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্রে ঐক্যের পরিবর্তে বিভাজনকে, শহীদ এবং আহতদের পরিবর্তে কিছু মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর কথা এবং মতামতকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সেখানে উপস্থিত থাকার কোনো ইচ্ছা বা প্রয়োজন আমি বোধ করিনি।'
পান্না বলেন, ‘এজন্য তিনিও সাগর পাড়ে গিয়েছিলেন। দলীয় নেতাদের জানানোর ক্ষেত্রে হাসনাত বলছেন, ৪ঠা আগস্ট রাতে প্রথমে তিনি এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তাকে না পেয়ে পরবর্তী সময়ে দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীকে অবহিত করেন যে, তিনি তার স্কুল বন্ধুদের সঙ্গে দুইদিনের জন্য ভ্রমণে যাচ্ছেন। যেহেতু নাসীরুদ্দীন সে সময় দলীয় কার্যালয়ে আহ্বায়কের সঙ্গে ছিলেন, তিনি তাকে আহ্বায়ককে বিষয়টি জানাতে অনুরোধ করেন। নাসীরুদ্দীন তাকে জানান যে, তিনি তা করবেন। এরপর নাসীরুদ্দীন তাকে নিশ্চিত করেন, তিনি আহ্বায়ককে বিষয়টি জানিয়েছেন। এ ছাড়া আরো একটি কারণ হলো হাসনাত ঢাকা শহরে থাকবেন না। তিনি কর্মসূচিতে আসবেন না। কারণ, অনেক শহীদ ও আহতদের পরিবর্তে কিছু মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর কথা এবং মতামতকে প্রধান্য দেওয়া হয়েছে। এজন্য এখানে উপস্থিত না থেকে তিনি এক নীরব প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছেন।’
পান্না বলেন, ‘পূর্ব ঘোষণা ছাড়া কক্সবাজার যাওয়া, বিলাসবহুল রিসোর্টে ওঠা, আবার হোটেল পরিবর্তন করা—এসব কোনো কিছুই গোয়েন্দা সংস্থার নজর এড়িয়ে যায়নি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ডিজিএফআই (সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা), রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এবং আরো একাধিক সংস্থার সদস্যরা গত দুইদিন ধরে এই আলোচিত শীর্ষ পাঁচ নেতার গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখছেন। গোয়েন্দারা হোটেলের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে খতিয়ে দেখছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা জানি না পরবর্তীতে কোনো বয়ান দেওয়া হবে কি না যে, কারো সঙ্গে দেখা বা বৈঠক হয়েছিল? আবার হাসনাত আব্দুল্লাহ কিন্তু বলছেন, যখন তারা কক্সবাজারে পৌঁছান তখন থেকেই গোয়েন্দা নজরদারিতে ছিলেন। তাদের বিভিন্ন ছবি সংগ্রহ করে গোয়েন্দা সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় সাপ্লাই দেন।’
দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের কথা উল্লেখ করে পান্না বলেন, “তারাই প্রথমে গোয়েন্দা নজরদারির বিষয়টি ব্রেকিং করেছে। তারা বলছে এই বিষয়টি একাধিক গোয়েন্দা সদস্য তাদের কাছে স্বীকার করেছেন। ঊর্ধ্বতনের নির্দেশে গোয়েন্দা সদস্যরা কক্সবাজারে অবস্থানরত এনসিপি নেতাদের ওপর নজর রাখছে। যদিও কারো সঙ্গে তাদের বৈঠকের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাদেরকে আবার ‘হোয়াইট’ করে তোলার জন্য কোনো কোনো গোয়েন্দা সংস্থা আবার এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছে কি না আমরা তা জানি না, ধারণা করছি মাত্র।”
মঞ্জুরুল আলম পান্না প্রশ্ন করেন, এই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কারা চালাচ্ছে? কাদের হয়ে কাজ করছে? ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মধ্যে আমরা জানি যে, আসিফ মাহমুদ এবং মাহফুজ আলমের মধ্যে চরম বিরোধ। এ বিষয়ে আমি আগে কথা বলেছি। এদিকে আবার এনসিপির মধ্যেও এক গ্রুপ বলছে আমরা এই সফরের বিষয়ে জানি, আবার আরেক গ্রুপ বলছে আমরা জানি না। আসলে কী ঘটছে? এনসিপির কার্যক্রম আমরা শুরু থেকে দেখছি, তাতে এই দল বেশিদিন টিকে থাকার কথা নয় কিংস পার্টি হিসেবে। আমরা তাও বাদ দিই, তাদের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে অভিযোগ। যেমন দখলবাজি, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, গ্রুপিং— এগুলোকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে এখন চরম বিভক্তি।’
তিনি বলেন, ‘এখন চিন্তার বিষয় হচ্ছে, কার সঙ্গে কিসের বৈঠক ছিল, সে সম্পর্কে আমরা এখনো নিশ্চিত নই। যদিও অনেক ধরনের গুঞ্জন উঠছে। কিছু গুজব হতে পারে আবার কিছু সত্য হতে পারে। সব মিলিয়ে আমাদের ভয়ের কারণ হলো, নিশ্চয়ই কিছু ঘটছে। ভয়ংকর কিছু ঘটছে। কিছু কিছু হয়তো প্রকাশ পাবে, কিছু কিছু হয়তো না-ও জানতে পারি। যা কিছু ঘটছে নিঃসন্দেহে ভালো কিছু নয়।’
খবরটি শেয়ার করুন