ছবি: সংগৃহীত
দৈনিক আমাদের নতুন সময়ের ইমেরিটাস এডিটর ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খানের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘাতকদের সঙ্গে হাত মেলানো খন্দকার মোশতাকের ‘ছায়া’ দেখছেন সাংবাদিক ও কলামিস্ট আনিসুল হক। তিনি দৈনিক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও নামকরা কথাসাহিত্যিক। নাঈমুল ইসলাম খানকে যেদিন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, সেদিনই আনিসুল হক ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ করেছিলেন যে, শেখ হাসিনার পতন আসন্ন। এ ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ সত্যও হয়েছিল বলেও তার দাবি।
গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাত্র ১৯ দিন পর আনিসুল হক সাবেক সরকারের প্রতি তার সমর্থন 'প্রত্যাহার' করে এমন দাবি করেন। ২০২৪ সালের ২৪শে আগস্ট 'ভোট ও বাক্স্বাধীনতা না থাকলে যা হয়...' শিরোনামে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয়তে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘ওই নিয়োগের (নাঈমুল ইসলামকে প্রেস সচিব) দুই মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই জনতার বিক্ষোভের প্রবল তরঙ্গ-অভিঘাতে শেখ হাসিনা ও তার ১৫ বছরের শাসনের লৌহদুর্গ খড়কুটোর মতো ভেসে যায় এবং তার উপলক্ষটা হয়, ওই প্রেস সচিব সঞ্চালিত একটা সাংবাদিক সম্মেলনে দুই সাংবাদিকের (একাত্তর টিভির সাবেক সাংবাদিক ফারজানা রূপা ও এটিএন নিউজের সাবেক সাংবাদিক প্রভাষ আমিন) মোসাহেবি মার্কা দুটো প্রশ্ন।’
২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দলের প্রায় সব নেতা-কর্মী ও বুদ্ধিজীবী অদৃশ্য হয়ে যান! নব্বইয়ের দশকের গণ-অভ্যুত্থানে এইচ এম এরশাদের পতনের পর যখন জাতীয় পার্টির অধিকাংশ নেতা জেলে, তখন মিজান চৌধুরী দলের নেতৃত্ব দিয়ে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সংসদে ৩৫টি আসন পেতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৫ বছর আওয়ামী লীগের সরকার বিএনপিকে অফিসে বসতে দেয়নি, মাঠে দাঁড়াতে দেয়নি এবং দলটির নেতা-কর্মীদের মামলা দিয়ে ব্যাপক ধরপাকড়, জেল-জুলুম করেছে।
তা সত্ত্বেও বিএনপির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী দলের কার্যালয়ে থেকে প্রতিদিন বক্তৃতা-বিবৃতি-সমালোচনা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগের কেউ কোথাও নেই। তাদের লন্ডভন্ড দলীয় কার্যালয় এখন ছিন্নমূল মানুষের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে দলটির সরকারের পক্ষে সরব থাকা ও সাবেক সরকারের সুবিধাভোগী সাংবাদিক আনিসুল হকও চুপ। তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষে আর কলম ধরছেন না। এমনকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে সাংবাদিক ও গণমাধ্যম নিপীড়ন প্রসঙ্গেও তিনি চুপ, এই পর্যন্ত কোনো টুঁ-শব্দটিও করেননি।
নাঈমুল ইসলাম খানের মধ্যে খন্দকার মোশতাকের ‘ছায়া’ দেখার বর্ণনা করে আনিসুল হক চুপটি মেরে আছেন। জাতীয় ইস্যুতে কথা বলছেন না নিরাপদ অবস্থানে থেকেও। সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক প্রকাশ্যে না থাকলেও তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের 'থিংক ট্যাংক' হিসেবে দৃশ্যপটের আড়ালে থেকে কাজ করছেন।
আজ শনিবার (১৩ই সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দৈনিক প্রথম আলোর কার্যালয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠক হয়। ‘নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার পথ’ শিরোনামে আয়োজিত বৈঠকের আয়োজক প্রথম আলো হলেও এর নেপথ্যের অন্যতম ব্যক্তি আনিসুল হক। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অনির্বাচিত সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করতে 'জনমত তৈরির লক্ষ্যে' আমেরিকাপন্থী সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে এ ধরনের বৈঠকের প্রায় নিয়মিত আয়োজন করে আসছে প্রথম আলো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ বিদ্বেষীরাই বৈঠকগুলোতে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে থাকছেন।
এদিকে, ২০২৪ সালের ২৪শে আগস্ট প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে আনিসুল হক লেখেন, ‘জুন মাসের ৭ তারিখ, ২০২৪। প্রজ্ঞাপন জারি হলো, তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব হিসেবে একজন সম্পাদককে (নাঈমুল ইসলাম খান) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষুদ্র কলাম লেখক (আনিসুল হক) তা দেখে তার পত্রিকার বার্তাকক্ষে সহকর্মীদের উদ্দেশে একটা ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেন, হাসিনা সরকারের পতনের আর দেরি নেই। সাংবাদিক সহকর্মীরা বললেন, এটা কেন বলছেন?’
তখন আনিসুল হক বলেন, ‘বলছি, তার কারণ আছে। বঙ্গবন্ধু তার পরিবারকে বলেছিলেন, যদি কোনো বিপদ আসে, প্রথম ফোনটা করবে তোমাদের মোশতাক চাচাকে। খন্দকার মোশতাক বিদূষক হিসেবে ছিলেন সবচেয়ে এগিয়ে। এমন নয় যে, এ নতুন প্রেস সচিব খন্দকার মোশতাকের মতো ষড়যন্ত্র করবেন। কিন্তু তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে একটিমাত্র যোগ্যতায়।’
আসিনুল হকের মতে, ওই যোগ্যতা হলো- ‘তিনি (নাঈমুল ইসলাম) তোষামোদি করতে পারেন সবচেয়ে বেশি। তার মানে প্রধানমন্ত্রী তোষামোদি ছাড়া অন্য কোনো কিছু গ্রহণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি শুধু তা-ই শোনেন, যা তিনি শুনতে চান। তিনি শুধু তা-ই দেখেন, যা তিনি দেখতে চান। এ অন্ধত্ব ও বধিরতা পতন ডেকে আনে।’
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন নিয়েও কথা বলেন আনিসুল হক। তিনি বলেন, ‘একেকটা বিদেশ সফর শেষে গণভবনে তখনকার প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) সংবাদ সম্মেলনের নামে যা হতো, তা চরম লজ্জাজনক প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। এসব দেখা মানে ছিল নির্মল বিনোদন আর চরম উষ্মার উদ্রেক করা।’
অনেকে মনে করেন, আনিসুল হক নিজেও আওয়ামী লীগের পুরো শাসনামলে দলটি ও এর নেতৃত্বে গঠিত সরকারের ‘গুণমুগ্ধ’ ছিলেন। সরকারের বিভিন্ন অন্যায়কেও তিনি বিভিন্ন সময় সমর্থন করে কলাম লিখেছেন। সরকারকে 'ব্রিবত' করে, এমন লেখা আওয়ামী লীগের টানা দেড় দশকের শাসনামলে আনিসুল একবারও লেখেননি। ভিন্ন রাজনৈতিক পরিবেশ পেয়ে নাঈমুল ইসলাম খানের উপর দায় চাপিয়ে দিচ্ছেন তিনি।
নাঈমুল ইসলাম খান আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাত্র দুই মাসেরও কম সময়ের আগে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। সরকার পতনের কারণে এ পদে তিনি থাকতে পারেননি। ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনের পতনের পর থেকে তিনি আছেন ‘নিরাপদ দুরত্বে’, বা ‘আত্মগোপনে’।
আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ ও আমাদের সময়ের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা নাঈমুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব হওয়ার আগে ছিলেন আমাদের নতুন সময় পত্রিকার ইমেরিটাস সম্পাদক।
আনিসুল হক স্ববিরোধী কথাবার্তা বলছেন বলেও অনেকের অভিযোগ। ২০২৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত ''স্যার! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার’: শামসুজ্জোহা থেকে আবু সাঈদ'' শিরোনামে এক লেখায় তিনি বলেন, 'বুদ্ধিজীবীদের একটা কাজ বিদ্রোহ করা, চিন্তার বিদ্রোহ। তারা নতুন কথা বলেন, বলে নিজেরা বিপন্ন হন। কিন্তু পৃথিবীকে এগিয়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বুদ্ধিজীবীরাও তা-ই করেছিলেন। ২০২৪-এর জুলাই গণ–অভ্যুত্থান আমাদের সাহস জোগাচ্ছে যে সেই উত্তরাধিকার ফুরিয়ে যায়নি।'
ওই লেখায় তিনি আরো বলেন, 'মিলান কুন্ডেরা বলেছেন, ক্ষমতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম হচ্ছে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম। তা-ই করে যেতে হবে, ভোলা যাবে না, ভুলতে দেওয়া যাবে না, আবার ক্ষমতার বিরুদ্ধেও লড়ে যেতে হবে। ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০, ২০২৪-এর বীর আর শহীদেরা সে আহ্বানই জানিয়ে যাচ্ছেন।' একসময়ের পাঠকনন্দিত লেখক ও কলামিস্ট আনিসুল হক বুদ্ধিজীবী হয়েও কী এমন ভূমিকা পালন করছেন? তিনি কী গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের পক্ষেও কিছু বলছেন?
খবরটি শেয়ার করুন