ছবি - সংগৃহীত
‘কিশোর গ্যাং’-এর সদস্যরা ভয়ংকর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখল, নারীদের উত্ত্যক্ত করার মতো জঘন্য অপরাধ করে যাচ্ছে। এ ধরনের ‘কিশোর গ্যাং’-শুধু ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ এক যুগ আগেও আমাদের দেশে এ ধরনের ‘কিশোর গ্যাং' এর অস্তিত্ব ছিল না। তখন এসব কাজ করতো চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। এখন সে জায়গা দখল করে অপ্রাপ্ত বয়সের কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশজুড়ে হঠাৎ করে অপরাধ বেড়েছে। কিশোর-গ্যাংয়ের সদস্যরা হত্যা, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, জমি দখল, নারীদের উত্ত্যক্ত করার মতো কাজ করছে। এখন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের যেকোনো স্পটে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে প্রথমেই উচ্চারিত হচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের নাম।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৮৫টি প্রাণ ঝরেছে। এর মধ্যে একাধিক আলোচিত হত্যাকাণ্ডও ছিল। কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য শুরু হওয়ার প্রথম দিকে ২০১৫ সালের ২৭শে মে উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে অনিক নামের এক কিশোর খুন হয়। এর পর ২০১৮ সালের ৬ই জানুয়ারি উত্তরায় ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার নামে দুইটি কিশোর গ্যাং গ্রুপের ঘরোয়া দ্বন্দ্বে খুন হয় নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির। মূলত আদনান খুন হওয়ার পর উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশত কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পায় পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বিগত সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, গত এপ্রিলের আগে রাজধানীতে অন্তত ১২৭টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় ছিল। আর সারা দেশে ছিল ২৩৭টি। এসব গ্যাংয়ের সদস্য ছিল দুই হাজারের বেশি। তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে তালিকা তৈরি করেছিল প্রতিটি থানা। কিন্তু পুলিশের সূত্র মতে, গত আন্দোলনে অধিকাংশ থানা পুড়ে যাওয়ার কারণে সেই তালিকাও ধ্বংস হয়ে গেছে। সংগত কারণে এখন নতুন করে আবার কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা তৈরি করা লাগছে। গত কয়েকদিন ধরে ঢাকায় যৌথ বাহিনী অরাজক পরিস্থিতি সামাল দিতে কিশোর-তরুণ অপরাধীদের তালিকা করে গ্রেফতারে অভিযানে নেমেছে। বেশকিছু গ্রেফতারও হয়েছে।
শুধু রাজধানীর মোহাম্মদপুরেই গত তিন মাসে ২১ জন খুন হয়েছেন। এসব হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগ ঘটনায় কিশোর-তরুণ অপরাধীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। কয়েক দিনের যৌথ বাহিনীর অভিযানে দেড় শতাধিক অপরাধী ধরা পড়েছে, যাদের বেশির ভাগই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য।
ঢাকার বাইরেও সমান তালে তাদের অপরাধ চলছে। গত ২৬শে অক্টোবর রাতে চাঁদপুর শহরের পুরানবাজার জাফরাবাদে ওয়াজ শুনতে গিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় গুরুতর আহত হয় আল-আমিন একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সিফাত পাটোয়ারী। ২৭শে অক্টোবর সন্ধ্যায় চাঁদপুরের ছায়াবাণী এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হয় ঢালীরঘাট এলাকার স্কুলছাত্র রাশেদ (১৫)। ২৮শে অক্টোবর চাঁদপুর শহরে অস্ত্র নিয়ে কিশোর গ্যাং মহড়া দেয় এবং তারা দুজনকে কুপিয়ে জখম করে। তিন দিন শুধু চাঁদপুরেই এই ঘটনা ঘটেছে। এরকম ঘটনা চট্টগ্রাম, রাজশাহী, যশোর, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘটছে। যার কারণে জনগণের মধ্যে মারাত্মক উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশজুড়ে প্রশাসনের শিথিলতার কারণে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য আশংকাজনক হারে বেড়ে চলেছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু গ্রেফতার করে এই কিশোর গ্যাং নির্মূল করা সম্ভব নয়। জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ধর্মীয় ব্যক্তিগণ ও অভিভাবকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। কিশোর-তরুণ অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। ফলে দেশ মারাত্মক রকমের ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
আই.কে.জে/