ছবি: সংগৃহীত
ড. মাহবুব উল্লাহ
গত সপ্তাহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আবহাওয়া হঠাৎ করে খুব গুমোট হয়ে গিয়েছিল। প্রাকৃতিক ঝড় মোখার ছোবল থেকে অনেকটাই আঁচড়মুক্ত থাকলেও মনে হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঝড়ের কবলে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
এটা এক ধরনের অনুমান। এ অনুমানের ভিত্তি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে বিবিসির ইয়ালদা হাকিমের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া সাক্ষাৎকার।
সম্প্রতি বিদেশ সফর থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর এই সফরের ওপর প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, যে দেশ নিষেধাজ্ঞা দেবে, তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ কোনো কিছু কিনবে না।
কোনো রাষ্ট্রদূতই আর পুলিশের এসকর্ট বা বাড়তি নিরাপত্তা সুবিধা পাবেন না বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। এখন থেকে এ সেবা পেতে অর্থ পরিশোধ করতে হবে বলেও জানান তিনি। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সরকারি খরচে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বিদেশি কোনো রাষ্ট্রদূতকে বাড়তি নিরাপত্তা সেবা দেওয়া হবে না।
এসব উক্তি বা সিদ্ধান্তের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে জাত্যাভিমান রয়েছে। তবে বিনা পয়সায় কোনো মধ্যাহ্নভোজ হয় না। ঠিক তেমনি জাত্যাভিমানী অবস্থানকে ধরে রাখতে হলে একটা মূল্য তো দিতে হবে। তার পরিমাণ কত তা হয়তো এ মুহূর্তে বলার সময় আসেনি। তবে এটুকু বলা যায়, এগুলোর তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি আছে। পরিণতি বেশ জটিল এ কারণে যে, এসব ঘটনার পেছনে বড় শক্তিগুলোর দ্বন্দ্ব জড়িয়ে আছে। একইসঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ।
এসব প্রশ্নে আলাপ-আলোচনা ও বিতর্কের প্রকৃষ্ট স্থান হলো জাতীয় সংসদ। কিন্তু এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের যে অবয়ব, তাতে ফলপ্রসূ আলোচনারও সুযোগ দেখি না। প্রিন্ট মিডিয়ায় এ নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। কিন্তু সেই প্রয়াস কতটা সাফল্য বয়ে আনবে তা নিয়েও দুর্ভাবনা আছে।
গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হলো, যে কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সহনশীলতা ও ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে মতবিনিময়ের সুযোগ অব্যাহত রাখার স্বাধীনতা। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমাদের দেশে গণতন্ত্রকে পরিপক্ব হতে হলে আরও অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে।
এখন অনেকেই হয়তো হক কথা পছন্দ করবেন না। বোকারাই কেবল সেই প্রান্তরে বিচরণ করে, যেখানে বুদ্ধিমানরা প্রবেশ করতে সাহস পায় না। আপাতত বোকাদের মতো আচরণ করতে চাই না। সুতরাং ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ নিয়ে আজকের আলোচনাটি করব।
পৃথিবীর ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ এক ডলারেরও কম সমমূল্যে দিনাতিপাত করে। অনেকে এর চেয়েও ঢের কম নিয়ে জীবনযাপন করে। বস্তুত বিশ্ব অর্থনীতির বড় একটি অংশে টাকারই প্রচলন নেই। সেখানকার বাসিন্দারা কখনোই বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় প্রবেশ করেনি।
আমরা যারা এখন টাকার জগতে বাস করি, তাদের পূর্বপুরুষরা, বিশেষ করে সুদূর অতীতের পূর্বপুরুষরা টাকা ছাড়াই জীবন কাটিয়ে গেছেন। তারা যতটুকু উৎপাদন করতে পারতেন ততটুকুই ভোগ করতেন। তারা তাদের বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মুদ্রা অর্থনীতিতে প্রবেশ করতে পাগলপারা ছিলেন।
টাকার অর্থনীতিতে প্রবেশের জন্য সাতটি দরজা পার হতে হয়। ধরা যাক, আমরা একটি হলঘরে প্রবেশ করতে চাইছি যেখানে সাতটি বড় প্রকোষ্ঠ রয়েছে। এ সাতটি প্রকোষ্ঠেরই প্রবেশের দরজা তালাবদ্ধ রয়েছে। এসব তালা খুলতে গেলে কী করতে হবে তার নির্দেশনা প্রতিটি দরজায় দেওয়া আছে। কী লেখা আছে সেসব দরজায়? এগুলো নিম্নরূপ :
প্রথম দরজা : এমন কিছু তৈরি করুন যা বিক্রয়যোগ্য। যেমন, উদ্বৃত্ত শস্য, আঁকা একটি মুখায়ব, অথবা এক জোড়া স্যান্ডেল। একজন ক্রেতা খুঁজে বের করুন এবং এভাবে প্রথম দরজাটি খুলে যাবে।
দ্বিতীয় দরজা : একটি চাকরি জোগাড় করুন। কাজ করুন। বিনিময়ে টাকা রোজগার করুন। আপনি টাকার জগতে প্রবেশ করলেন। এভাবে আপনি দৃশ্যমান একটি অর্থনীতির জগতে প্রবেশ করলেন। আপনি দ্বিতীয় দরজায় প্রবেশ করলেন।
তৃতীয় দরজা : উত্তরাধিকার সূত্রে আপনি কিছু অর্থের মালিক হলেন, আপনার পিতা-মাতা অথবা আপনার মামা, চাচারা আপনার জন্য কিছু অর্থ রেখে গেছেন। এভাবে তৃতীয় দরজাটি খুলে যাবে। এভাবে আপনি টাকার জগতে প্রবেশ করতে পারেন এবং অবস্থাভেদে চাকরি না করলেও চলবে।
চতুর্থ দরজা : আপনি কোনো উপহার পেলেন কারও কাছ থেকে, সেই উপহার নগদ টাকাও হতে পারে অথবা এমন কোনো জিনিস হতে পারে যা বিক্রয় করে টাকা পাওয়া যায়। এক কথায় বলতে হয় উপঢৌকন, তা যে রূপেই পাওয়া যাক না কেন, তা দিয়ে টাকার জগতে প্রবেশ করা যায়।
পঞ্চম দরজা : এমন একজন স্বামী অথবা স্ত্রী জোগাড় করুন, যিনি এসব দরজা দিয়ে হেঁটেছেন এবং তিনি আপনার সঙ্গে তার অর্জিত টাকা ভাগ করে ব্যবহার করবেন। এভাবেও টাকার জগতে প্রবেশ করা যায়।
ষষ্ঠ দরজা : রাষ্ট্রের নাগরিক হলে এবং বিশেষ করে সেই রাষ্ট্র যদি কল্যাণ রাষ্ট্র হয়, তাহলে রাষ্ট্র আপনার কাছে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু টাকা হস্তান্তর করবে। এই টাকা খুবই সামান্য হতে পারে। তবে যে পরিমাণ টাকা এভাবে আপনি পাবেন, তার মাত্রা অনুযায়ী আপনি টাকা ব্যবস্থার অংশীদার হবেন।
আরো পড়ুন: মাঠ ভরা বোরো ধান, চালের বাজার সহনীয় হবে কি!
সপ্তম দরজা : চুরি করেও টাকার মালিক হওয়া যায়।
অবশ্য এই সাতটি পন্থার কিছু ব্যতিক্রম আছে। যেমন ঘুস খাওয়া অথবা দৈবক্রমে টাকা অথবা সমমূল্যের সম্পদ জোগাড় করা। তবে উপর্যুক্ত সাতটি পন্থায় মানবজাতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টাকার অর্থনীতিতে প্রবেশ করেছে। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে টাকার অর্থনীতি অথবা দৃশ্যমান অর্থনীতির মূল্য হবে একশ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
আমাদের এ পৃথিবী বছরে এ পরিমাণ অর্থনৈতিক মূল্য তৈরি করে; কিন্তু বিশ্ববাসী যদি বছরে এর দ্বিগুণ পরিমাণ পণ্য, সেবা ও অভিজ্ঞতা উৎপাদন করে, তাহলে কী হবে? যদি হিসাবের বাইরে আরও ১০০ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে যায়, তাহলেই বা কী হবে? যা হিসাবে আসে না তার হিসাবটা জানা মানব কল্যাণের বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করবে।
বিশ্বে যেভাবে প্রযুক্তির অগ্রগতি হয়েছে, তার ফলে সুপার কম্পিউটার, হলিউড, হিপ-হুপ মিউজিক, জৈব বিপদ, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ লুণ্ঠন এবং মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব সন্ধান পৃথিবীর অর্থনৈতিক চেহারাকে বদলে দিচ্ছে প্রবলভাবে। মজার ব্যাপার হলো, এ সাত দরজার বাইরে টাকার অর্থনীতিতে প্রবেশের হাজারও দরজা আছে। হতে পারে এগুলো লুকায়িত অথবা হিসাবের বাইরে। এই দরজাগুলো সবার জন্যই খোলা। এটা টাকাওয়ালাদের জন্য যেমন সত্য, তেমনি সত্য যাদের টাকা নেই তাদের জন্যও।
এমন পরিস্থিতিতে শ্রেণি বিশ্লেষণ কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ এমনই অবস্থায় টাকার জগতে প্রবেশের জন্য সবার পূর্বপ্রস্তুতি সম্পন্ন। টাকার জগতে প্রবেশের এ বিশ্লেষণটি আমাদের দিয়েছেন আলভিন এবং হিডি টফলার তাদের লেখা Revolutionary Wealth গ্রন্থে।
বাংলাদেশে একসময় লোকে বলতে শুরু করেছিল, ঢাকার বাতাসে টাকা ওড়ে। যে কেউ চেষ্টা করলে সেই বাতাস থেকে উড়ন্ত টাকা ছিপকাঠি দিয়ে পেড়ে নিতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে টাকার চৌহদ্দি গত পঞ্চাশ বছরে বহুগুণ সম্প্রসারিত হয়েছে। কীভাবে হলো, তা নিয়ে একটি ধারণাত্মক আলোচনা করব কোনো এক সময়।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ
এসি/ আই. কে. জে/
খবরটি শেয়ার করুন