শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গোয়েন্দা সংস্থার অফিস ও থানায় নির্যাতন - যেসব কারণে আলোচিত 'মহানগর-২'

বিনোদন ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ১২:৩৯ অপরাহ্ন, ৩০শে এপ্রিল ২০২৩

#

ওসি হারুন চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোশারফ করিম

পুলিশের একজন ওসিকে থানা থেকে উঠিয়ে এনে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ এবং তার অতীত কাহিনী নিয়ে নির্মিত ‘মহানগর ২' ওয়েব সিরিজ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের দর্শকদের মধ্যে বেশ আলোড়ন ফেলেছে।

কোনও একটি গোয়েন্দা সংস্থার ‘গোপন ডিটেনশন সেন্টারে’ কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ হয় এবং সেখানে কীভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির টেলিফোন কথোপকথন রেকর্ড করা হয়, তার একটি ধারণা দেয়া হয়েছে ‘মহানগর ২ সিরিজের’ মাধ্যমে।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে কোনও নাটক, সিনেমা কিংবা ওয়েব সিরিজ নিয়ে এতোটা আলোচনা হয়নি। গণমাধ্যম বিশ্লেষক এবং দর্শকরা বলছেন, মহানগর ২ সিরিজে যেসব বিষয় উঠে এসেছে সেগুলো যেন সমসাময়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। এই সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্র ওসি হারুন দর্শকদের কাছে পরিচিত একটি নাম হয়ে উঠেছে।

একজন সংসদ সদস্যের সাথে মেয়রের দ্বন্দ্ব, মানুষজনকে উঠিয়ে নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ, একজন শীর্ষস্থানীয় ধনী ব্যবসায়ীর সন্তানের বেপরোয়া আচরণ – এসব বিষয় উঠে এসেছে মহানগর ২ সিরিজের মাধ্যমে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মহানগর ২ সিরিজে যেসব চরিত্র কিংবা বিষয়বস্তু তুলে ধরা হয়েছে সেগুলোর সাথে বাস্তবের চরিত্র এবং ঘটনা মেলাতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।

“বাংলাদেশে গত ১০ বছরে যা ঘটেছে তার অনেক বিষয় এই মহানগর সিরিজের মাধ্যমে উঠে এসেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন চলচ্চিত্র এবং মিডিয়া বিশ্লেষক ফাহমিদুল হক।

“একজন বিলিয়নিয়ারের কাণ্ড-কীর্তি, ইন্টেলিজেন্স (গোয়েন্দা) বিভাগের কাণ্ড-কীর্তি, একজন নারী মেয়র ও একজন এমপির মধ্যে দ্বন্দ্ব – এসব কিছু উঠে এসেছে এখানে।”

মহানগর সিরিজ কি ব্যতিক্রমী?

বাংলাদেশে তৈরি নাটক এবং সিনেমার বড় অংশ মূলত প্রেম কাহিনী নির্ভর। বাস্তব ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নাটক কিংবা সিনেমা তৈরির নজির খুব একটা দেখা যায় না। বিশেষ করে যেসব ঘটনার সাথে রাজনীতির সম্পৃক্ততা থাকে সেসব বিষয় এড়িয়ে চলতে পছন্দ করেন নির্মাতারা। সে দৃষ্টিতে ‘মহানগর ২’ সিরিজকে ব্যতিক্রম হিসেবে বর্ণনা করছেন অনেকে।

বাংলাদেশে গত ১০ বছরে বহু মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর দাবি হচ্ছে, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থা তাদের তুলে নিয়ে তাদের ‘গুম’ করেছে। বছরের পর বছর ধরে অনেকের কোন খোঁজ নেই। এই তালিকায় সরকার-বিরোধী রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ আছে।

“আমি সময়টা ধরার চেষ্টা করেছি। আমরা যে সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি কিংবা যে সময়টা আমাদের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন ‘মহানগর ২’ সিরিজের পরিচালক আশফাক নিপুণ।

মহানগর সিরিজে দেখানো হয়েছে ওসি হারুনের পাশাপাশি আরো একজন ব্যবসায়ীকে বিমানবন্দর থেকে তুলে এনে গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়েছে। সে ব্যক্তি জানেন না তার অপরাধ কী? এমনকি কারা তাকে তুলে এনেছে সেটিও তিনি জানেন না।

বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি যা দেখা গেছে মহানগর ২ সিরিজ যেন সেটির প্রতিচ্ছবি, এমনটাই বলছেন ফেরদৌস আরা রুমি, যিনি এই সিরিজের একজন দর্শক।

“এসব ঘটনা নিকট অতীতে ঘটেছে। আমরা এগুলো ভুলে যাইনি। এই সিরিজটা দেখে মানুষ ঘটনাগুলো রিলেট করতে পারছে,” বলেন মিস্ রুমি।

গল্পের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, বাংলাদেশের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীর ছেলের বেপরোয়া জীবন। তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা মেয়েটিকে খুঁজে শায়েস্তা করার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজছেন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর ছেলে। তাকে এই কাজে সহায়তা করছে গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে কর্মরত এক ব্যক্তি।

এই চরিত্রটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে অনেকেই এর সাথে বাস্তব চরিত্রের মিল খুঁজে নিচ্ছেন। পরিচালক আশফাক নিপুণ বলছেন, তিনি গল্পের প্রয়োজনে নানা চরিত্র উপস্থাপন করেছেন। অনেক চরিত্র বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিতও হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

“কে কী মেসেজ পেয়েছে, সেটা দর্শকদের উপর নির্ভরশীল। দর্শক এটা নিয়ে নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করছে, সে স্বাধীনতা তাদের আছে,” বলেন মি. নিপুণ।

আরও পড়ুন: সংগীত শিল্পী ন্যানসির জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার চুরি করলো কে?

ওসি হারুন চরিত্র ও ক্ষমতার কাঠামো

গল্পের মূল চরিত্র ওসি হারুন। এ ভূমিকায় ছিলে অভিনেতা মোশারফ করিম। তাকে নিয়ে একটা গল্প তৈরি হয়েছে। পরিচালক মি. নিপুণ বলছেন সে গল্প আশপাশের উদাহরণ কিংবা পারিপার্শ্বিকতা দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।

গল্পের চরিত্রে ওসি হারুনকে উপস্থাপন করা হয়েছে একজন ধূর্ত ও স্মার্ট পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে। তিনি তার ক্ষমতা ও বলয়ের মধ্যে সবকিছু করার চেষ্টা করেন। তিনি তার চেয়ে কম ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের সাথে সংঘাতে যান না। তার চেয়ে যারা বেশি ক্ষমতাবান, তাদের সাথে ওসি হারুনের লড়াই।

মহানগর-১ সিরিজে দেখানো হয়েছিল, ওসি হারুন তার থানায় সর্বেসর্বা। তাকে টেক্কা দেবার কেউ ছিল না। থানায় যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন ওসি হারুন। পাওয়ার স্ট্রাকচার বা ক্ষমতার কাঠামোর সম্পর্কে ওসি হারুন ততটা অবগত ছিলেন না।

মহানগর-২ সিরিজে দেখানো হয়েছে, ক্ষমতার উপরেও ক্ষমতা আছে। ওসি হারুনকে যারা তুলে এনেছে তারা আরো ক্ষমতাবান।

“সিস্টেমের কোনায় কোনায় ভূত। ভূতের উপরেও ভূত আছে। বাপের উপরেও বাপ আছে,” বলেন মি. নিপুণ।

বাংলাদেশে মত প্রকাশ ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা গত এক দশকে অনেকটা সংকুচিত হয়েছে বলে দেশে এবং আন্তর্জাতিক মহলে বেশ সমালোচনা আছে। ক্ষমতাবান কিংবা ক্ষমতার কাঠামোকে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে এক ধরণের ভীতি তৈরি হয়েছে।

মহানগর ২ তৈরির ক্ষেত্রেও পরিচালক আশফাক নিপুণকে সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে ভাবতে হয়েছে। “সকল গোষ্ঠীকে খুশি করে এ ধরণের গল্প বলা যায় না। অনেকে খুশি হবে, আবার কেউ না কেউ অখুশি হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে রিস্ক নিতে হয়,” বলেন মি. নিপুণ।

অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন স্পর্শকাতর ঘটনার উপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু সেগুলোর ফলাফল ভালো হয়নি।

দশ বছর আগে ঢাকার কাছে সাভারে রানা প্লাজা বিধ্বস্ত হয়ে এগারোশ’র বেশি শ্রমিক নিহত হয়েছিল। সে ঘটনা নিয়ে নজরুল ইসলাম খান নামের একজন পরিচালক ‘রানা প্লাজা’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু সে সিনেমা আর কখনো মুক্তি পায়নি। বিষয়টি নিয়ে পরিচালক দীর্ঘ আইনি লড়াই করলেও তাতে কোন কুল কিনারা হয়নি।

প্রায় সাত বছর আগে ঢাকার গুলশান এলাকায় হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা নিয়ে ‘শনিবার বিকেল’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন পরিচালক মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী। কিন্তু জাতীয় চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড সেটির ছাড়পত্র দেয়নি।

তিন বছর আগে ‘নবাব এলএলবি’ নামের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন পরিচালক অনন্য মামুন। পুলিশকে হেয় করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা হয়। ফলাফল হিসেবে কারাগারে যেতে হয়েছিল মি. মামুনকে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা।

এমএইচডি/ আই. কে. জে/

মানবাধিকার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র বিনোদন গোয়েন্দা সংস্থা পুলিশ নাটক সিনেমা

খবরটি শেয়ার করুন