সোমবার, ৮ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তরুণদের মধ্যে দেশ ছাড়ার প্রবণতা এত বেশি কেন

সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০১:৩৯ অপরাহ্ন, ৬ই জুন ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

ইদানীং তরুণদের কোনো আড্ডায় যোগ দিলে সব বিষয় ছাপিয়ে আলোচনা যেন একবিন্দুতে এসে দাঁড়ায়। শুধু কি আড্ডায়? আত্মীয়স্বজন, নিকটজন, বন্ধুদের সাধারণ আলোচনায়ও বিষয়টি চলে আসে। আর তা হলো, বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে কার কী পরিকল্পনা। কে আইইএলটিএস দিয়েছে, ‘ফুল স্কলারশিপ’পেতে কত স্কোর লাগবে, কার ক্লাস কবে শুরু, ইউরোপ ভালো হবে নাকি আমেরিকা, নাকি অস্ট্রেলিয়া বা কানাডা। 

আমাদের মেধাবী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছেলেমেয়েরা বিদেশে পাড়ি জমাতে হন্যে হয়ে চেষ্টা করছেন। পড়াশোনা শেষে আবার ফিরে আসবেন কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে, অনেকের উত্তর, ‘আগে তো যাই, তারপর দেখা যাবে।’

তরুণদের এই প্রবণতাকে কোনোভাবেই নেতিবাচক বলতে পারি না।

তবে এর আগে বলা দরকার, বিদেশে উচ্চশিক্ষায় গমনের ক্ষেত্রে একটা নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে। একটা সময় ছিল, কেবল ধনী পরিবার, বড় ব্যবসায়ী, মন্ত্রী-মিনিস্টার আর আমলাদের পুত্রকন্যারাই এ সুযোগ পেতেন বা নিতেন। সমাজের ক্ষমতাশালীরা অবশ্য সব সময় নিজের সন্তানসন্ততিদের বিদেশে নিরাপদে রাখার নীতিতে বিশ্বাসী।

যা-ই হোক, এখন মধ্যবিত্ত তো বটেই, সাধারণ গরিব ঘরের, এমনকি কৃষক পরিবারের সন্তানেরাও উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছেন। ওয়েবসাইটে ঢুকে আবেদন করে, বৃত্তি অর্জন করে, প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে, ধারকর্জ করে টিকিট কিনে, ব্যাগপত্র গুছিয়ে উড়োজাহাজে উঠে বসছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরিতে থাকছেন, ক্লাস করছেন, লেখাপড়ার ফাঁকে যতটুকু কাজের সুযোগ আছে, তা গ্রহণ করছেন। কেউ টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট বা টিএ হিসেবে আগেই মনোনীত হচ্ছেন। সবকিছুই একধরনের শৃঙ্খলার মধ্যে সেখানে চলছে বলে প্রতীয়মান হয়।

আরেকটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি, সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়েরাও তাদের মেয়েকে পর্যন্ত উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ পাঠাচ্ছেন। আগে সাধারণত বিয়ের পর মেয়েদের বিদেশ পাঠানোর অনুমতি দিতেন বাবা-মায়েরা। এখন বিয়ের আগেই মেয়েরা যেতে পারছে। চিন্তার এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে হয়।

যারা পড়তে যান বা পড়া শেষে সেখানে কাজ জুটিয়ে নেন, স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য অনুমতি পান, সবার খবর শুনে, ছবি দেখে ভালো লাগে। তাদের কেউ কেউ বলেন, তারা যেখানে গেছেন, সে দেশে বা সে শহরে একটা ‘লাইফ’ আছে। লেখাপড়া, কাজ, আড্ডা, বেড়ানো—সবই চলছে। অবশ্য লাইফের ধারণা সব সময়ই ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়।

একজন মানুষ কীভাবে তার জীবন গোছাবেন, এটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। তারপরও আমাদের বিশেষ করে ২ কোটি ১০ লাখ মানুষের ঢাকা শহরে যতটা বায়ুদূষণ, যতটা শব্দদূষণ, এই যন্ত্রণা থেকে তো তারা আপাতত মুক্তি পেয়েছেন, এটা ভেবে ভালোই লাগে।

যারা মেধাবী, তারা যদি এভাবে শয়ে শয়ে দেশ ছাড়তে থাকেন, তাহলে দেশটাকে কারা এগিয়ে নেবে? ভবিষ্যতে কারা নেতৃত্ব দেবে? ‘ঠেকার কাজ চালানোর’ মতো লোক দিয়ে একটি দেশ কীভাবে সামনের দিনগুলোতে কঠিন, কঠোর প্রতিযোগিতায় নাম লেখাবে?

আমাদের প্রিয় বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট এগিয়েছে ও এগোচ্ছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ দৃষ্টিনন্দন সব অবকাঠামো তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির যন্ত্রণা সত্ত্বেও জীবনমান বেড়েছে, মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু সার্বিকভাবে বেড়েছে। তারপরও এটা হয়তো তরুণদের বিদেশমুখিনতা আটকানোর জন্য যথেষ্ট নয়। অথবা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ধারা আর তরুণদের বাইরের দুনিয়ার প্রতি আগ্রহ—দুটি ভিন্ন বিষয়। এ বিষয়ে বোধ করি সমাজ-গবেষকেরা ভালো ব্যাখ্যা করতে পারবেন।

তরুণদের অনেকের মধ্যে এ রকম ধারণা আছে, ঠিকমতো পড়াশোনা করলেও ফলাফলে তা প্রতিফলিত হবে না। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চাকরি জুটবে না। কোনো না কোনোভাবে বৈষম্যের শিকার হওয়ার ঝুঁকি তার জীবনে আসতে পারে। আর চলমান বাস্তবতা তো এটা অস্বীকার করে না যে আমাদের শিক্ষাঙ্গন কলুষিত। ছাত্ররাজনীতি একেবারেই ঠিক পথে নেই। আজ থেকে দুই-আড়াই দশক আগে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন ছাত্র রাজনীতি দেখেছি। অনেক কিছু বদলেছে, আবার অনেক কিছু বদলায়নি। লাঠালাঠি, কোপাকুপি থেকে গেছে এখনো। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আজও নির্যাতিত। এমন অবস্থায় একজন সাধারণ মেধাবী তরুণ বা তরুণী বিদেশমুখী হয়ে স্বাভাবিক জীবন বেছে নেবে না কেন?

Important Urgent

খবরটি শেয়ার করুন