শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মানুষ কী তবে জীবন নিয়ে ভাবনাই ছেড়ে দিয়েছে?

নিউজ ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ১০:১১ পূর্বাহ্ন, ৮ই এপ্রিল ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

বঙ্গবাজারের আগুনের শোকের মাঝেই অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ফায়ার সার্ভিস। বৃহস্পতিবার ফায়ারের কর্মকর্তা যখন মার্কেটের সামনে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছিলেন, তখন গাউছিয়া মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছিলেন। পরে তিনিও কথা বলেন সাংবাদিকদের সাথে। কিন্তু সিঁড়িতে কেন দোকান, ক্রেতাদের হাঁটার পথে কেন দোকান এবং সেগুলো কীভাবে বসল, কারা ভাড়া দিল, আগুন লাগলে তা থেকে বাঁচার জন্য কী ব্যবস্থা আছে – এরকম কোনো প্রশ্নেরই তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেন নি। আসলে তারা তো কেবল মাস শেষে ভাড়ার টাকা গোনেন, জীবন বাঁচানোর কথা ভাববার সময় কোথায়?

আগুনের ঝুঁকিতে এই গাউছিয়া আসলে ঠিক একটি মার্কেট নয়। আছে ঘিঞ্জি করে লেগে থাকা আরও সাতটি মার্কেট। একটির সাথে একটি লেগে থাকা এই মার্কেটগুলোকে আলাদা করা যায় শুধু সিঁড়ির টাইলস-এর রং দিয়ে। এতগুলো মার্কেট, এত ব্যবসায়ী ও এত দোকানী, এত ক্রেতা– কিন্তু সচেতনতা নেই, নেই আগুন লেগে গেলে বের হওয়ার পথ এবং ফায়ার সার্ভিসের জন্য পানির ব্যবস্থা।

ঢাকায় এমন অসংখ্য মার্কেট আর বিপণী বিতান আছে যেগুলো কোনোটিই সুরক্ষিত নয়। তাই আগুন মার্কেটের পিছু ছাড়ছে না। কারণ সেখানে অগ্নি প্রতিরোধে মজবুত ব্যবস্থা নেই। গুলশান-১ এর ডিসিসি মার্কেটে দুইবার আগুন লেগেছে, আবার ব্যবসা শুরু হয়েছে, কিন্তু অনেক প্রতিশ্রুতির পরও অগ্নিঝুঁকি থেকে বাঁচার কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই ব্যবসা শুরু হয়েছে।

ফি বছর আগুন লাগে এই শহরে। বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে ছারখার হয়ে যায় নিমতলি, চুড়িহাট্টা, লালবাগ, বনানী, গুলশান, বঙ্গবাজার। বিপর্যয়ের এই দীর্ঘ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ঢাকার বাজারগুলোয় আগুন ঠেকানোর নিশ্ছিদ্র বন্দোবস্ত করা হচ্ছে না। এত বড় বড় বাজারে ন্যূনতম অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। যখনই আগুন লাগে, তা নিয়ে দিন কয়েক হইচই হয়। তারপর সব থিতিয়ে যায়। কেন কিছু করা হচ্ছে না, সেটা আসলে রহস্যময় বলে মনে করার কিছু নেই। পুরোটাই হল অবজ্ঞা। অবজ্ঞা এই কারণে যে, এসব আগুনে পুড়ে যায় অতি সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদ। উপরিতলে বাস করা ক্ষমতা কাঠামোর লোকজনের তাৎক্ষণিক কিছু দুঃখ প্রকাশের বাণী উদগীরণ করা ছাড়া কোনো দায় বা দায়বদ্ধতা নাই।

বঙ্গবাজারের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল আশেপাশের মার্কেট ও স্থাপনায়ও। প্রাথমিকভাবে ছয় ঘন্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও সত্যিকার ভাবে প্রায় দেড়দিন লেগেছে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আনতে। চটজলদি পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় না বলেই দ্রুত আগুন ভয়াবহ চেহারা নেয়। বেশিরভাগ কেমিক্যালের গুদাম, কারখানা আর বাজার সরু গলির মধ্যে। সেই রাস্তারও কিছু অংশ দখলে। সরু এসব গলিতে গাড়ি নিয়ে ঢুকতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন দমকল কর্মীরা। তার উপরে এ শহরের বেশিরভাগ এলাকা ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় আগুন নেভাতে গিয়েও সমস্যায় পড়েন দমকল কর্মীরা। আর আছেন উৎসুক জনতা যাদের সামলানো আগুন নেভানোর চেয়ে কম বড় কাজ নয়।

প্রতিটি আগুনের ঘটনায় আমরা দেখি একি চিত্র। সেটা কারখানা হোক, বাজার হোক, বড় অট্টালিকা হোক- সামান্য অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও নেই। আগুন লাগার পরে মানুষ শুধু অসহায়ের মতো চিৎকার করেন। সব জায়গায় দাহ্য পদার্থ মজুত থাকে, অথচ পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকেনা। কেন থাকে না সে প্রশ্ন তুলেও কোন ফায়দা হচ্ছেনা।

বঙ্গবাজারে ঘটে যাওয়া আরেকটি ঘটনা আমাদের চরিত্রের জানান দিয়েছে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছানো এবং এ যাবতকালের সর্বোচ্চ ইউনিট কাজ করা সত্ত্বেও হামলা করা হয় বাহিনীটির সদর দপ্তরে। যখন বাহিনীটির সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যস্ত তখনই অতর্কিত হামলা করে ভাঙচুর করা হয় ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন মডেলের ১৪টি গাড়ি, মেইন গেটের সেন্ট্রি পোস্ট, প্রশাসনিক ভবন, সিনিয়র স্টেশন অফিসারের অফিস। উশৃঙ্খল কিছু লোক একযোগে অফিসে প্রবেশ করে ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোঠা নিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের বিভিন্ন সদস্যকে মারপিট করে। ভয়ংকর ঘটনা বলতেই হবে। খোদ প্রধানমন্ত্রীও এ ঘটনায় তার উষ্মা প্রকাশ করেছেন।

আমরা বাড়ি, দোকান, অফিস, কারখানা কোথাও আগুন লাগার সরঞ্জাম মজুত করে রাখব না। আগুন লাগলে দমকলের গাড়ি আটকাব, ভাংচুর করব এবং ভস্মীভূত হওয়ার সব দায় দমকলের উপর চাপাব। আমাদের নিজেদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব কি আমাদের নিজেদের নয়? সব মানুষের সব দায় পুলিশ, অ্যাম্বুল্যান্স ও দমকলের? আমাদের অভিযোগের অঙ্গুলি নির্দেশ কেন সব সময় অন্যের দিকে? এসব প্রশ্নেরও জবাব প্রয়োজন।

আমাদের অনেক অনেক সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ। কেউই দায়িত্ব নেয়না। কোনো পক্ষ থেকেই দায় স্বীকার ও জবাবদিহিতা নেই। সরকারি দপ্তরগুলোর এতো অনিয়ম-অন্যায়-অরাজকতা-অব্যবস্থাপনার সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিতে মানুষ এখন জীবন নিয়ে চিন্তা করাই হয়তো ছেড়ে দিয়েছে। তাই কোথাও ঝুঁকি মোকাবেলার চেষ্টা নেই। প্রশাসনিক জবাবদিহি যতদিন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভ্যাসে পরিণত না হবে, ততদিন কোথাও না কোথাও আগুন লাগবেই।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।

এমএইচডি/

বঙ্গবাজারের আগুন ফায়ার সার্ভিসরাজধানী গাউছিয়া মার্কেট

খবরটি শেয়ার করুন