সোমবার, ২৩শে ডিসেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৮ই পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** ২৯শে ডিসেম্বর লন্ডন যাচ্ছেন খালেদা জিয়া *** ২০শে জানুয়ারির মধ্যে সব পাঠ্যবই সরবরাহের নির্দেশ *** মুম্বাইয়ে অরিজিতের কনসার্টের টিকিটের মূল্য লাখ টাকা *** তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে রাহাত ফতেহ আলী খানের সৌজন্য সাক্ষাৎ *** সাধারণ মানুষ সংস্কার বোঝে না, তারা বোঝে যেন ভোট ঠিকভাবে দিতে পারে : ফখরুল *** বাংলাদেশকে আরও ৪০ কোটি ডলার দেবে বিশ্বব্যাংক *** নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান চলবে : পরিবেশ উপদেষ্টা *** ‘মহাকালের পাতায় হাসান আরিফের কৃত্তি লেখা থাকবে’ *** দুদক চেয়ারম্যান নিজের সম্পদের হিসাব দিলেন *** ওয়েজ বোর্ড সিস্টেম বাতিল করে সাংবাদিকদের নূন্যতম বেতন চালু করা উচিত : শফিকুল আলম

প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের তাৎপর্য

নিউজ ডেস্ক

🕒 প্রকাশ: ০৬:৪৫ পূর্বাহ্ন, ২৫শে এপ্রিল ২০২৩

#

ছবি: সংগৃহীত

খোকন কুমার রায়

বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে ৫১ বছর ধরে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। তবে এ দুটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক শতাব্দী প্রাচীন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই দুই দেশের জনগণের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক ছিল। কারিগরি শিক্ষার জন্য ভারতের এই অংশ থেকে বেশ কয়েকজনকে জাপানে পাঠানোর প্রাচীন প্রথা আজও বিদ্যমান। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও জাপানের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব বেশ সহায়ক ছিল। জাপানি শিক্ষার্থীরা তাদের মধ্যাহ্নভোজের অর্থ সে সময় বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য আলাদা করে রেখেছিল।
এই চমৎকার সম্পর্ক বজায় রাখতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে জাপান সফর করেন। এই সফরে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের শক্তিশালী ভিত্তি রচিত হয়। ফলশ্রুতিতে সকল সময়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে বাংলাদেশ জাপানের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। 
জাপানের প্রধানমন্ত্রী কিশিদা ফুমিওর আমন্ত্রণে ২৫ এপ্রিল চারদিনের সফরে জাপান গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফরকালে তিনি সে দেশের সম্রাটের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন। এই সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর বিশাল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। জাপান ইতিমধ্যে বাংলাদেশে একটি শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে যেখানে দেশটি ১২৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরে আট থেকে দশটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সফরকালে প্রধানমন্ত্রীর কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পাশাপাশি একটি বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন এবং একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কয়েকজন জাপানি নাগরিককে ‘ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার অনার’ প্রদান করবেন। 
এই সফরটিকে উভয় দেশের জন্যই অবিশ্বাস্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশ ও জাপান উভয়ই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বড় মিত্র। উল্লেখ্য, জাপান ইতোমধ্যে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঢাকা মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে ‘বিগ বি’ উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে জাপান। জাপান প্রস্তাবিত শিল্প অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল, ভুটান এবং শ্রীলঙ্কায় বাজারজাত করার জন্য সমুদ্রবন্দরের উন্নয়নসহ যোগাযোগ অবকাঠামো তৈরি করতে চায়।
মূলত চীনের প্রভাব ও সম্প্রসারণ ঠেকাতে জাপান ও ভারত যৌথভাবে এই অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। এই শিল্প অঞ্চলটি ভারতের উত্তর-পূর্ব এবং বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। গভীর সমুদ্রবন্দরটি ২০২৭ সালের মধ্যে কার্যক্রম শুরু করবে। এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ, ভারত, জাপানসহ সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য এটি অত্যন্ত লাভজনক হবে।
তবে সফরের সময় দুই দেশ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপন করছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ সম্পর্ক শুরু হয়। তারপর থেকে বাংলাদেশে জাপানের বিনিয়োগ প্রসারিত হয়েছে। উপরন্তু দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে দৈনিক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। এই সফরে থাকাকালীন প্রধানমন্ত্রী একটি কৌশলগত জোটের সাথে সম্পর্কের কথা উল্লেখ করতে পারেন।
২০২০-২০২১ সালে, জাপান বাংলাদেশকে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি সাহায্য দিয়েছে, মোট ২.৬৩ বিলিয়ন ডলার। জাপান বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করছে এমন কয়েকটি বড় প্রকল্প হলো ঢাকায় এমআরটি লাইন, মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল এবং আড়াইহাজারে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল।
জানা গেছে, ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের পাশাপাশি মাতারবাড়িতে গভীর পানির বন্দর পরিচালনায় জাপান আগ্রহী। জাপানও বাংলাদেশে সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানির পরিকল্পনা করছে। যেহেতু বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে এলডিসি উপাধি ত্যাগ করবে, তাই জাপানের সাথে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষর করতে চায়। সাম্প্রতিক অর্থবছরে বাংলাদেশ জাপানে ১.৩৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৪.৪০ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশে জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেছেন যে, জাপানের সুদূর-পূর্বে পোশাক রপ্তানি দ্রুতগতিতে বিকশিত হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।
সাম্প্রতিক অর্থবছরে জাপানে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি মোট ১.১০ বিলিয়ন ডলার এবং ২০৩০ সাল নাগাদ এটি ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে বিক্রয় ১০ গুণ বেড়ে ১০ বিলিয়ন ডলার হবে।
একই সময়ে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিকট ভবিষ্যতে বৃদ্ধি পাবে। কারণ জাপান থেকে আমদানি পাঁচ গুণ বেড়ে ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে যা ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। জাপান সফরের সময়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল প্রকল্পগুলিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য জাপানের প্রতি শক্তিশালী সম্পৃক্ততার অনুরোধ করতে পারেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, "জাপান যেসব এলাকায় কাজ করছে (জায়ান্ট প্রজেক্ট) সেগুলো দেখে আমরা আনন্দিত।"

তার মতে, জাপান বাংলাদেশে একটি ভালো বিনিয়োগকারী এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। জাপান বর্তমানে বৃহৎ প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশের অর্থের প্রধান উৎস।
মূল ভিত্তি হলো, জাপান অর্থায়ন করতে পারে এবং তা করতে পারে ধারাবাহিকভাবে, কঠিন শর্ত আরোপ না করে। উপরন্তু তাদের প্রযুক্তি আছে। সিঙ্গাপুর এবং জাপানের মতো দেশের জন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 
তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, বন্দর পরিকাঠামো পরিচালনা এবং সরবরাহ করা এমন একটি বিষয় যাতে জাপানও আগ্রহী।  
তিনি বলেন, আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন প্রকল্পের জন্য অর্থায়ন ও প্রযুক্তি প্রয়োজন। এটাও একটা চ্যালেঞ্জ হতে পারে।  
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানের প্রোঅ্যাকটিভ অ্যাঙ্গেজমেন্ট চাইবে বাংলাদেশ। কারণ তাদের প্রত্যাবর্তন এখনও শুরু হয়নি।
বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির মতে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু দেখতে জাপান সহায়তা অব্যাহত রাখবে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়নের কারণে রাখাইন ছেড়ে আসা ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ বর্তমানে আবাসন ও খাবার দিচ্ছে।
বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি দিতে জাপানের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে মোমেন বলেন, বাংলাদেশের প্রধান উদ্বেগ হচ্ছে জনগণের কল্যাণ। বাংলাদেশের তাৎপর্য তুলে ধরে তিনি বলেন, আহার, বাসস্থান, পরিচর্যা এবং আমাদের জনগণকে শিক্ষিত করার বিষয় সবার আগে আসে। এরপর আমরা অন্যান্য বিষয়গুলো দেখব।
বাংলাদেশ-জাপান কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জে সরকার-টু-সরকার চুক্তির ভিত্তিতে জাপানি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির মাইলফলক বলা যেতে পারে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কোভিড-১৯-পরবর্তী বিশ্বব্যাপী স্থবিরতা এবং মন্দার প্রেক্ষাপটে এটি অবশ্যই ভালো খবর। এক হাজার একরের শিল্পনগরীতে এরই মধ্যে ৪০টি বিদেশি কোম্পানি বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।  
কর্মসংস্থান হবে লাখ লাখ বেকারের। ভালো ভৌগোলিক অবস্থান এবং নৌ ও সমুদ্র বন্দরসহ যোগাযোগ অবকাঠামোর মাধ্যমে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ৩০০ মিলিয়ন মানুষের বাজার হতে পারে। তাছাড়া বিদ্যুৎ-গ্যাস-জ্বালানি-পানি এবং বিশেষ সুবিধাসহ ওয়ান স্টপ পরিষেবা রয়েছে। সব মিলিয়ে অনুকূল বিনিয়োগবান্ধব নীতি ও আইন। পর্যাপ্ত শ্রম সম্পদ সস্তায় পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী সব দেশ যেমন উপকৃত হবে তেমনি বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিও নিশ্চিত হবে।
এর পাশাপাশি আগামী পাঁচ বছরে অন্তত ১৫টি সেক্টরে লাখ লাখ বাংলাদেশি দক্ষ কর্মী নিয়োগের চুক্তিও করেছে জাপান। তবে তাদের সে দেশের ভাষা জানতে হবে। এটি বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগের সূচনা এবং সেই সাথে সে দেশে শিল্প ও দক্ষ মানবসম্পদ স্থানান্তরও চিহ্নিত করেছে। কিন্তু শিল্প স্থাপনের জন্য তা যথেষ্ট নয়। একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আন্তঃবাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য যথাযথ অবকাঠামোসহ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক অপরিহার্য। বাংলাদেশ ও জাপান সরকারও সেদিকে যথাযথ মনোযোগ ও গুরুত্ব দিয়েছে।

খোকন কুমার রায়: কবি, সাংবাদিক

আরো পড়ুন:

ঢাকা শহর হয়ে পড়ছে অনেকটা পানিশূন্য

 

প্রধানমন্ত্রী জাপান সফর তাৎপর্য

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন