শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানের প্রাণহানির মামলা

উপ-সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০৯:৩৪ অপরাহ্ন, ১২ই নভেম্বর ২০২৩

#

ছবি-ফাইল

কাজী জহিরুল ইসলাম

শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত রচয়িতা আনন্দ সামারাকুন আত্মহত্যা করেছিলেন শুধু এই দুঃখ ও ক্ষোভে যে তাঁকে না জানিয়ে তাঁর গানের প্রথম কলিটি বদলানো হয়েছে। এখন কাজী নজরুল ইসলাম জীবিত থাকলে যদি দেখতেন তাঁর অমর সংগীত কারার ঐ লৌহ কপাটের সুর ও কথা বদলানো হচ্ছে, তিনি না জানি কী করতেন।  

সামারাকুনের গানটি শুরু হয় ‘নম নম মাতা’ দিয়ে। গানটি জাতীয় সংগীতের মর্যাদা লাভ করার পর কয়েক বছর শ্রীলঙ্কা প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যেতে থাকে। অনেকে তখন বলেন, জাতীয় সংগীত ‘নম নম’ দিয়ে শুরু হয়েছে বলেই আমাদের জাতীয় বিপর্যয়। 

পরে প্রথম লাইনটি পরিবর্তন করে লেখা হয়, ‘শ্রীলঙ্কা মাতা’। দ্বিতীয় লাইনে অবশ্য ‘নম নম নম মাতা’ কথাটি আছে। প্রথম লাইনের দুটি নম বদলে দিয়ে শ্রীলঙ্কা শব্দটি যুক্ত করা ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। এই সামান্য পরিবর্তন মেনে নিতে পারেননি গানটির রচয়িতা আনন্দ সামারাকুন। 

আনন্দ সামারাকুন শ্রীলঙ্কার একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি ও গীত রচয়িতা। তিনি সাহিত্য ও সংগীতের ওপর পড়াশোনা করেন শান্তিনিকেতনে।  গানের শব্দ পরিবর্তনে আনন্দ খুব অপমানিত বোধ করেন। তিনি বলেন, ওরা আমার দেহে ছুরি চালাল অথচ আমাকে তা জানানোরও প্রয়োজন বোধ করল না? তিনি এই অপমান নিতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। 

শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে, নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য ভারতবর্ষের বাঙালিরা যে গান গেয়ে উজ্জীবিত হয়েছেন যুগে যুগে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যে গান কোটি বাঙালিকে উদ্দীপ্ত রেখেছে, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত গান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট/ভেঙে ফেল কর রে লোপাট’–এ নতুন করে সুরারোপ করেছেন ভারতের বিখ্যাত সংগীত ব্যক্তিত্ব এ আর রহমান।

যতদূর জানি নজরুল তাঁর রচিত সাড়ে চার হাজার গানের অধিকাংশে নিজেই সুর দিয়েছেন, গেয়েছেন। কিছু গানে অন্য সুরকারও সুরারোপ করেছেন। 

তবে নজরুলের মতো একজন উঁচু মাপের সংগীতজ্ঞ একটি গান লিখেছেন আর সেই গানটি লেখার সময় একটা সুরে গুনগুন করেননি– এটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই। সেই অর্থে তাঁর রচিত সব গানেই তিনি সুর দিয়েছেন, হয়তো সুযোগের অভাবে কোনো কোনো গান রেকর্ড করতে পারেননি বা কাউকে সুরটি শিখিয়ে দিতে পারেননি।

যা কোটি কোটিবার শ্রুত, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই যে সুর বাঙালির হৃদয়ে ঝংকৃত হয়, সেই গানে নতুন করে সুর দেওয়ার প্রচেষ্টাটি অন্যায়। এই গানের মৌলিক সুরটি নজরুল ছাড়া অন্য কারও দেওয়া তেমন কোনো সুরকারের নাম আজ পর্যন্ত কোথাও পাওয়া যায়নি। 

এ আর রহমান বিশ্বনন্দিত একজন সুরকার, সংগীতব্যক্তিত্ব। তিনি ভারতের সংগীতকে আন্তর্জাতিকভাবে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন; জনপ্রিয়তার নিরিখেও তাঁর অবদান অসামান্য। তাঁর প্রতিভার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, তিনি যা করেছেন তা অন্যায়।

শিল্পধর্মের পবিত্রতা এর মৌলিকত্বে। এত বড় একজন শিল্পী হয়ে তিনি যদি তা বুঝতে না পারেন তাহলে আমি বলব শিল্পের জ্ঞানে তিনি সমৃদ্ধ, কিন্তু এখনও প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠেননি। 

গানের ইম্প্রোভাইজেশন শ্রোতাদের মধ্যে এখন বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে লোকজ গানগুলো ইম্প্রোভাইজেশনের ফলে অনেক বেশি শ্রোতানন্দিত হয়েছে, হচ্ছে। যে কোনো প্রচলিত গান ইম্প্রোভাইজ করার জন্য এ আর রহমান উপমহাদেশের মধ্যে একজন অতি যোগ্য ব্যক্তি। 

তিনি যদি গানটির মূল সুর ঠিক রেখে ইনস্ট্রুমেন্টাল ইম্প্রোভাইজেশন করতেন, আমরা নিশ্চয়ই স্বাগত জানাতাম। গানটির মূল সুরের সঙ্গে কথার যে সামঞ্জস্য, দ্রুত দাদরা তালে দ্রোহের যে বাজনাটি শ্রোতার অন্তরে বেজে ওঠে, তা এ আর রহমানের নতুন সুরে নেই। এই গানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নজরুল যে দ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছেন, তাতে এ আর রহমান জল ঢেলে দিয়েছেন। 

যদিও এ আর রহমানের সুরটিকে বাতিল করার জন্য এ তুলনার কোনো প্রয়োজনই নেই, তবুও তুলনাটি এ জন্য করলাম যে উপমহাদেশের একজন বিরাট প্রতিভাধর সুরকারও নজরুলের কাছে কতটা তুচ্ছ, তা কী সহজেই না বোঝা যায়। 

তসলিমা নাসরিন তাঁর এক স্ট্যাটাসে সন্দেহ পোষণ করেছেন, ‘এ আর রহমান হয়তো জানেনই না কাজী নজরুল ইসলাম কে ছিলেন।’ অর্থাৎ এটি কার লেখা, আগে এর সুর হয়েছিল কিনা, এসব না জানিয়েই সিনেমার পরিচালক তাঁকে দিয়ে কাজটি করিয়েছেন। 

আরো পড়ুন: কল্যাণরাষ্ট্রের রূপরেখার মাঝে অগ্নিসন্ত্রাসের ছোবল

এটি হওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ সিনেমাটির জন্য নজরুলের মতো একজন বিখ্যাত কবির গান নির্বাচন করেছেন, কেন এই লিরিক নিলেন, কেন এটি প্রাসঙ্গিক– এসব নিয়ে দু-চার কথা হয়নি, মূল সুরটি কেমন ছিল, তা তিনি শুনতে চাননি, এটি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। যদি হয়ও, যেহেতু সুরটি তিনিই করেছেন, আমরা তো তাঁকেই দোষ দেব, নিন্দা জানাব। 

পিপ্পা সিনেমাটি যেন এ আর রহমানের সুরে গাওয়া ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানসহ কিছুতেই মুক্তি না পায়। দুই বাংলার বাঙালিদেরই উচিত হবে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে শিল্পের মৌলিকত্ব রক্ষায় সরব হওয়া।

কাজী জহিরুল ইসলাম: কবি ও কথাসাহিত্যিক 

এসি/ আই.কে.জে/


‘কারার ঐ লৌহ কপাট’

খবরটি শেয়ার করুন