শুক্রবার, ৫ই জুলাই ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২১শে আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দেবীপক্ষে, দেবীর পক্ষে

সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০১:৪১ অপরাহ্ন, ৩১শে অক্টোবর ২০২৩

#

প্রতীকী ছবি

অমিতায়ু চক্রবর্তী

শাক্ত কবি যখন আবেগতাড়িত হয়ে হিমালয়-জায়ার বয়ানে লিখলেন, “এবার আমার উপায় এলে আর উমা পাঠাব না”— মনের গভীরে তিনি জানতেন এ কেবলই কথার কথা। বাস্তবে, সামাজিক চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে উমার পিতৃগৃহে দীর্ঘ প্রবাস সম্ভবপর হবে না কোনমতেই।

তাই দেবীপক্ষের শুরুতে যে প্রতিরোধ অলঙ্ঘ্য বলে মনে হয়েছিল, সে প্রতিরোধ দুর্বলতর হতে হতে দিনের শেষে ঘাড়ধাক্কার রূপ পরিগ্রহ করে।

“যেও না নবমী নিশি” — মর্মে মেনকা যতই কাঁদাকাটা করুন না কেন, তিনি নিজেও এ কথা জানতেন, যে নবমীর রাত পোহালে যদি তার মেয়ে শ্বশুরবাড়িমুখো না হয়, তবে তার মেয়ের বধ করা সমস্ত অসুর সামাজিকতার অব্যর্থ বরে বেঁচে ওঠে তার চারপাশে বর্বর নৃত্য আরম্ভ করবে এবং তার মেয়ে দশ হাতেও সমাজের পাঁচ কান বন্ধ করতে পারবে না।

বোধনের বাজনার গভীরে যে বিসর্জনের প্রস্তুতি চলে, এই রূঢ় সত্যকেই কোমলতার কিংখাবে ঢাকতেই এত কথা, এত গান, এত গল্প আর এত আয়োজন। এত মলাটের প্রয়োজন এই কারণেই। 

দিনশেষের গলা ধাক্কায় মেয়ের ঘাড় ভেঙে যায় যাক ক্ষতি নেই, কিন্তু তার হৃদয় যেন অক্ষত থাকে। ভগ্নহৃদয়ে সে শ্বশুরবাড়ী গেলে সেখানে বাপের বাড়ীর নিন্দে হবে। এই দ্বি-চারণ আজকের নয়, অনাদিকাল থেকেই এর বিষ আমাদের শিরা-উপশিরায় প্রবাহমান।

হিমালয়ের পাথুরে সত্তার অন্তরে এক রক্ত-মাংসের মানুষী সত্তা ও তাতে পিতার আবেগ কল্পনা করে নিলে এবং দেবী দুর্গার সঙ্গে তার এক পার্থিব বাবা-মেয়ের সম্পর্ক স্বীকার করে নিলে এ কথা বলা যেতে পারে যে, হিমালয়ের সমস্ত প্রজা অর্থাৎ, হিমালয়ের পাদদেশে বসবাস করা সকলেই আসলে দেবী দুর্গার বাপের বাড়ির লোক এবং সেই হিসেবে আমাদের সঙ্গে দেবীর সম্পর্কের দূরত্বটাও লতায় পাতায় নেহাত কম দূরবর্তী নয়। 

শোনা যায় বিয়ের পর না কি মেয়ের বাবা-মা ও তার আপন থাকে না, আর সেখানে দূর সম্পর্কের বাপের বাড়ির লোকের কাছে নৈকট্য বা আন্তরিকতা আশা করাটা মানুষের পক্ষেই বোকামির—সেখানে দৈব মাপকাঠির কথা না হয় উহ্যই থাক।

অতঃপর প্রশ্ন আসতে পারে সমস্ত ব্যাপারটা যদি এতই দায়সারা তবে এত আড়ম্বরের ঘনঘটা কেন! নেহাত অকারণে তো এসব হওয়ার কথা নয়। এ প্রশ্নের উত্তর হয়ত বোঝার পক্ষে একটু জটিল।

যেভাবে বহু অখ্যাত কবি বিখ্যাত কবিদের ভণিতায় পদ রচনা করে ঐতিহাসিকদের ভ্রান্তির সুযোগ নিয়ে ইতিহাসের পাতায় অমর করে যেতে চেয়েছিলেন তাদের লেখনী—যে মানসিক অবস্থায় তারা এ দুশ্চেষ্টা করেছিলেন, এক্ষেত্রেও প্রায় একই ধরনের মানসিকতার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।

প্রাচীনকালে যখন বারোয়ারি বা সর্বজনীনতার আগ্রাসন শুরু হয়নি, তখনও দুর্গাপুজো ছিল বিপুল অর্থ ও প্রতিপত্তির আতশবাজি। রাজসূয় যজ্ঞের আধুনিক সংস্করণ এই পুজো তার জন্মলগ্ন থেকেই ছিল ক্ষমতাশালীর ক্ষমতা তথা প্রতিপত্তি প্রদর্শনের শাস্ত্র-অনুমোদিত পথ। 

সময় বদলে গেলেও বদলায়নি উৎসবের লক্ষ্য বা উপলক্ষ্য। পুঁজিবাদ, সমাজবাদ পার হয়ে আজকের “আমরা সবাই রাজা”র যুগে নিজ নিজ রাজত্বের জৌলুসের কার্নিভাল হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে এই উৎসবকেই। তার আধুনিক গালভরা নামকরণ হয়েছে সর্বজনীন দুর্গোৎসব। প্রাচীন মহোৎসবের অর্বাচীন অপভ্রংশ এই বারোয়ারি মোচ্ছব। 

দেবী দুর্গার বাপের বাড়ির অতি দূর সম্পর্কের এই আত্মীয়রা তাই দেখনদারির স্বার্থে এই উৎসবটিকে আত্মীয়তার মলাটে জিইয়ে রেখেছেন, রেখে চলেছেন বছরের পর বছর। 

যেভাবে হিমালয়-পত্নী অবাধ্য সময়কে অনুনয়ের বাঁধনে বাঁধতে না পেরে ভাগ্যকে দোষ দিয়ে রেহাই পেতে চেয়েছিলেন মেয়ের চোখের জল থেকে, খানিকটা সেভাবেই আত্মীয়তা ও পরিবার বন্ধনের ভেলকিতে স্বচ্ছ দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে বিকৃত উল্লাস ও পাশবিক উদ্দামতার তার একটা সমাজ তথা নীতি অনুমোদিত ব্যাখ্যা খুঁজতে চেয়েছি আমরা। নইলে হয়ত এই জান্তব উল্লাস, শোভনীয় হত না এতখানি। 

তাড়িয়ে দিতে হবে জেনেই দেবীর আবাহন হয় প্রতিবছর। ভক্তিগদ আচার-অনুষ্ঠানের ফাঁকে ভক্ত ও ভগবান দুপক্ষই অপেক্ষা করে থাকে সেই মুহূর্তের, যখন আত্মীয়তার আলিঙ্গন শেষে ঘাড় ধাক্কা প্রতীক্ষা করে থাকে। বহু বছরের অভ্যাসে আলিঙ্গন থেকে কুলোর বাতাসের এই খাড়াই পথটা মসৃণ হয়েছে,  বুঁজিয়ে দেওয়া হয়েছে তার অমসৃণ খানাখন্দগুলো।

আরো পড়ুন: ‘সুখবর’ ফিরিয়ে আনলো হাতে লেখা চিঠি, আমরা নস্টালজিক হয়ে পড়ব

বিদায়ী চোখের জলের অজুহাত হয়েছে ধূপের ধোঁয়া। বিদায়ী ঘাড়ধাক্কার কালসিটে ঢেকে দিয়েছে ফুলের মালার স্তূপ। কাঁসর-ঢাকের যুগলবদ্ধ কোলাহলে “দূর হয়ে যা” শোনায় “আবার এসো মা”।

চিন্ময় দেবী মৃন্ময়ীরূপ পরিগ্রহ করার সময় নির্ঘাত কোনো দৈব উপায়ে অবশ করে দেওয়া হয় তার বোধ শক্তিগুলোকে। না হলে সমবেত উল্লাসে জলে ফেলে দেওয়ার অপমান, দুঃখ, অভিমান তিনি কিছুতেই ভুলতে পারতেন না এক বছরে। ফি-বছরের এই ছলনা দেবী চিন্ময়ী রূপে সইতে পারতেন না। 

নগ্নতাই হয়ত মানুষের একমাত্র সত্য কিন্তু জাতীয় ঐতিহ্যে নগ্ন হতে আমাদের আড়াল লাগে। প্রকারান্তরে বলা যায়, আড়াল পেলে নগ্নতাই আমাদের একমাত্র বিকল্প। অসভ্যতাকে আড়াল করে তাকে প্রশ্রয় দেওয়াই যদি সভ্যতার নামান্তর হয়, তবে মধুসূদনের সেই প্রশ্ন আজও বড্ড প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়— একেই কি বলে সভ্যতা? 

এসি/ আই.কে.জে/



দেবীপক্ষ দেবী

খবরটি শেয়ার করুন