তাপস হালদার, সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
তাপস হালদার :
উপমহাদেশে শতশত রাজনৈতিক দল থাকলেও তিনটি দলের ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, পাকিস্তানের মুসলিম লীগ এবং বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ। কংগ্রেসের নেতৃত্বে এসেছে ভারতের স্বাধীনতা। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। এ কারণেই উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই তিনটি দলের গুরুত্ব ও মর্যাদা আলাদা। কিন্তু ভাষা আন্দোলন, সুমহান মুক্তিযুদ্ধ ও দেশকে অর্থনৈতিক মুক্তি দেয়া এমন সব গৌরব পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনও রাজনৈতিক দলের নেই। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে দল হিসেবে গৌরব ও অর্জনে এগিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ববাংলার সকল মানুষের উপর বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে পাকিস্তানি শাসকচক্র। প্রথমেই মাতৃভাষা বাংলার উপর আঘাত করা হয়, উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, বঞ্চনার প্রতিবাদে প্রগতিশীল নেতাকর্মীরা একত্রিত হয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ'। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, আতাউর রহমান খান, শওকত হোসেন ও আলী আহমেদ খান সহ-সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক, কারাবন্দি তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন।
আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে দলটা যাত্রা শুরু করলেও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে সকল ধর্মাবলম্বীদের দলে সুযোগ করে দেয়া হয়। নতুন নাম দেয়া হয়-পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। যা স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
আওয়ামী লীগ দলটি প্রতিষ্ঠার পরই পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। জনগণের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে দলটির খুবই দ্রুত জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬-এর ছয়দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। যার ফলে বঙ্গবন্ধু বাংলার অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হন। এজন্যই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার বৈধ প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ পান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে (১২ জানুয়ারী ১৯৭২ সাল থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫) মাত্র সাড়ে তিন বছর সরকারে ছিল আওয়ামী লীগ। এ সময়ের মধ্যে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলো হলো: সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মাত্র দশ মাসে একটি সংবিধান জাতিকে উপহার দেয়া, ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার, ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত প্রায় এক কোটি লোককে দেশে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করা, বিশ্বের ১৪০টি দেশের স্বীকৃতি লাভ করা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে।
দীর্ঘ ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। পাকিস্তান আমলের ২৪ বছর এবং বাংলাদেশের ২৫ বছরের মধ্যে সেই সরকারই প্রথম বারের মত তাদের মেয়াদ পূর্ণ করে। তখন সরকার বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। তাহলো: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারের পথ সুগম করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল, সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব প্রবর্তন, সংসদকে শক্তিশালী করতে মন্ত্রীর পরিবর্তে সংসদ সদস্যদের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা, ভারতের সাথে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি স্বাক্ষর, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মহিলাদের সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা, নারীর ক্ষমতায়ন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ, মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক অনুদান প্রদান এবং বাঙালির গৌরব ভাষা আন্দোলন (২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২) ইউনেস্কো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন।
দ্বিতীয় দফায় দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে আওয়ামী লীগ। তারপর থেকে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় এসেই অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করেন। জাতির পিতা হত্যাকান্ডের বিচার সম্পন্ন করা ও রায় কার্যকর, ৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর, ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ভারত ও মায়ানমারের সাথে সমুদ্র সীমা বিরোধ নিষ্পত্তি, ভারতের সাথে দীর্ঘ ৬৮ বছরের পুরোনো স্থল সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তিসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করেন। এছাড়াও ডিজিটাল সেবাকে দেশের প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া, শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সেবা নিশ্চিতকরণ, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই বিতরণ, দারিদ্র্য হ্রাস, মাথাপিছু আয় দুই ডলারে উন্নীতকরণ, আশ্রয়ণ প্রকল্প, একটি বাড়ী একটি খামার প্রকল্পসহ অনেক জনবান্ধব কাজ করেছে সরকার।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা, মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১, রূপপুরে নির্মাণ করা হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, অসংখ্য ফ্লাইওভার যোগাযোগ অবস্থায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আওয়ামী লীগ সরকার ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন করে ভিশন-২০৪১ উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের দিকে এগিয়ে চলেছে। ঘোষণা করা হয়েছে ডেল্টা প্লান-২১০০।
আওয়ামী লীগের ৭৪ বছরের ইতিহাসে দলটি ক্ষমতায় ছিল ২৫ বছর। কিন্তু সরকারি দলে থাকার সময় যেমন জনগণের সেবা করেছে, আবার বিরোধী দলে থাকার সময় সব সময়ই জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে কাজ করেছে। কখনও জনগণ থেকে দূরে সরে যায়নি।
বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন তার নেতৃত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দিয়েছে স্বাধীনতা আর তাঁরই সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ দিয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তি।
সংগ্রাম, গৌরব ও অর্জনের ৭৪ বছরে পদার্পণ করল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই দীর্ঘ সময়ে লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী দেশের কল্যাণে আত্মত্যাগ করে দলটিকে মহীরুহে পরিণত করেছেন। আজকের শুভ দিনে প্রতিটি নেতাকর্মীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
ইমেইল: haldertapas80@gmail.com