ছবি : সংগৃহীত
১৩০ বছরের রেকর্ড ভেঙে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি একটানা না হয়ে এক মেয়াদের ব্যবধানে আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। এর আগে এমন কৃতিত্ব ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ২২তম প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের। যিনি ১৮৮৫ সালে ২২তম এবং ১৮৯৩ সালে ২৪তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়া দেশটির ইতিহাসে ট্রাম্পই একমাত্র প্রেসিডেন্ট,যিনি ইমপিচমেন্টের পরও পুনরায় নির্বাচিত হলেন। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বর্তমান ভাইস–প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেন। এটিকে নিঃসন্দেহে বলা যায়, ৭৮ বছর বয়সী রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঐতিহাসিক রাজকীয় প্রত্যাবর্তন।
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০২৫ সালের ২০শে জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করবেন। সেদিন থেকেই তিনি চার বছরের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। রীতি অনুযায়ী, ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট সরাসরি জনগণের ভোটে হন না। ইলেক্টোরাল ভোট নির্বাচিত করে। কোনো প্রার্থীকে বিজয়ী হতে হলে ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল ভোটের মধ্যে ২৭০ ইলেক্টোরাল ভোটের ম্যাজিক ফিগার স্পর্শ করতে হয়। ট্রাম্প সেখানে তিন শতাধিক ইলেক্টোরাল ভোট পেয়েছেন। শুধু ইলেক্টোরাল ভোটই নয়, পপুলার ভোটেও প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসকে বিশাল ভোটের ব্যবধানে পেছনে ফেলে ৪৭তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। ১০০ আসনের সিনেটে ৩৪টিতে ভোট হয় মঙ্গলবার। এতে রিপাবলিকান পার্টির আসন সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫২টি। ডেমোক্রেটিক পার্টির আসন নেমেছে ৪২টিতে। ৪৩৫ আসনের প্রতিনিধি পরিষদেও রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। বর্তমানে সিনেটে ডেমোক্র্যাট এবং প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। এবার দু’টিতেই রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। যার কারণে যে কোনো আইন প্রণয়নে আর বাধা থাকবে না।
বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার কারণে ফলাফল পেতে দেরি হবে, এমনকি কয়েকদিনও লাগতে পারে। তবে অবাক করার বিষয় হলো, নির্বাচন শেষ হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই ট্রাম্পের জয় স্পষ্ট হতে শুরু করে। বিশেষ করে দোদুল্যমান রাজ্য নর্থ ক্যারোলাইনা, জর্জিয়া, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিনে জয়ের মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের বিজয় নিশ্চিত হয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গণমাধ্যমগুলো ট্রাম্পের জয়ের পেছনে বাইডেন প্রশাসনের যুদ্ধবাজ নীতিকে দায়ী করছেন। মার্কিন ভোটারদের অনেকেই মনে করেন, কমলা হ্যারিস ও বাইডেনের দল আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা। মধ্যপ্রাচ্যে সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সুদানে গৃহযুদ্ধ এবং ইউরোপসহ বিশ্বের বেশকিছু অঞ্চলে সংঘাতময় পরিস্থিতির জন্য তারাই দায়ী।
আরো পড়ুন : শিল্পকলায় নাটক বন্ধ, কী ইঙ্গিত দিচ্ছে জাতিকে!
এজন্যই মুসলিম অধ্যুষিত দোদুল্যমান মিশিগানেও এগিয়ে যান ট্রাম্প। এখানে ট্রাম্প ৫০ শতাংশ ভোট পান।কমলা হ্যারিস পান ৪৮.১ শতাংশ ভোট। এই অঙ্গরাজ্যের সবচেয়ে বড় মুসলিম শহর হিসেবে পরিচিত ডিয়ারবর্নের আরব আমেরিকানদের সমর্থনও পেয়েছেন ট্রাম্প। প্রাপ্ত ফলাফল অনুসারে, শহরে কমলা হ্যারিস পেয়েছেন ২৮ শতাংশ ভোট এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪৭ শতাংশ। এ ছাড়া এখানে গ্রিন পার্টির জিল স্টাইন ২২ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। ফলাফলে বোঝা যাচ্ছে, ডিয়ারবর্নে আরবের মুসলিম ভোটাররা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ব্যাপক সমর্থন দিয়েছেন। আর এটিকে বাইডেন প্রশাসনের ইসরাইল-গাজার যুদ্ধ নিয়ে নেয়া পদক্ষেপের প্রতি স্পষ্ট প্রতিবাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মিশিগানের এই শহরের ভোটাররা গাজা যুদ্ধের বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের অবস্থান নিয়ে বরাবরই অসন্তোষ প্রকাশ করে এসেছিলেন। ভোটেও সেটা প্রমাণিত হয়েছে। আরব-আমেরিকানরা মনে করেন, ট্রাম্প বিশ্বের পরিবর্তন আনতে পারবেন। এবং দেশের যে পরিবর্তন দরকার সেই পরিবর্তনও ট্রাম্প আনতে পারেন। এজন্যই অনেক মুসলিম ভোটার প্রথমবারের মতো ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছেন। যদিও কমলা হ্যারিস জয়ী হলে গাজা যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন। ভোটাররা তার কথাকে বিশ্বাস করেনি। বাইডেন প্রশাসনের ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতি অব্যাহত সমর্থন এবং ইসরাইলে বারবার যুদ্ধাস্ত্র পাঠানোকে আরব-আমেরিকান ও মুসলিম ভোটাররা ভালোভাবে নেননি।
‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগান নিয়ে ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর দুইবার অভিশংসিত হয়েছিলেন ট্রাম্প। আলোচনা সমালোচনার মধ্যে চারটি বছর হোয়াইট হাউসে কাটিয়ে ২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয়ে বিদায় নেন।
অনেকেই মনে করেছিল, ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হয়তো সেখানেই শেষ হয়ে গেল। কিন্তু ৪ বছর পর ভোটের মাঠে বিস্ময়কর সাফল্যের পর আবারও হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন করতে যাচ্ছেন। যা ছিল অধিকাংশ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণার বাইরে। অবশ্য ভোটের আগেই ট্রাম্প সম্পর্কে তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা ব্রায়ান লাঞ্জার বলেছিলেন, একবার পরাভূত হওয়ার পর দ্বিগুণ উৎসাহে তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন। এটাই তার বৈশিষ্ট্য। দলীয় কর্মীরা তার লড়াকু মনোভাব, স্পষ্ট কথা বলা, সততা ও সাহসের জন্য পছন্দ করেন।
জয়ের পর নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ভোটের প্রচারে ট্রাম্প আমেরিকানদের বলেছিলেন, তিনি তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি ব্যবহার করবেন। তিনি হাজার হাজার সরকারি কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করবেন। তিনি সামরিক ধাঁচের অভিযান চালিয়ে লাখ লাখ অভিবাসীকে নির্বাসন দেবেন। তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে চূর্ণ করবেন; জনস্বাস্থ্য নিয়ে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচারে সরকারকে ব্যবহার করবেন এবং বিদেশে আমেরিকার মিত্রদের ত্যাগ করবেন। তিনি তার সমালোচকদের শাস্তি দিতে সরকারকে তার নিজের হাতিয়ারে পরিণত করবেন। তিনি তার সমর্থকদের ব্যাপকভাবে পুরস্কৃত করবেন। তিনি এসব করার ম্যান্ডেট চেয়েছিলেন এবং দেশের জনগণ বিপুল ভোটের মাধ্যমে তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করেছে।
নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর প্রথম ভাষণে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া বিশ্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তার সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষার ব্রত নিয়ে কাজ করবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, তিনি তার প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করেন সেটি দেখার অপেক্ষায় পুরো বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে।
এস/ আই.কে.জে/
খবরটি শেয়ার করুন