ছবি: সংগৃহীত
মানব পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার সেই মা শাহজাদী এবং তার মা নার্গিস বেগমকে জামিন দিয়েছেন আদালত। আইনজীবী, আদালত ও কারা কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতায় জামিন আদেশের দেড় ঘণ্টার মধ্যে আজ মঙ্গলবার (২৩শে সেপ্টেম্বর) দুপুরে তারা খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে মুক্তি পান। আদালত তাদের বেইলবন্ডও (জামিনের জন্য প্রদানকৃত নির্ধারিত অর্থ) মওকুফ করে দেন।
এদিকে মুক্তির পর ১৩ দিনের নবজাতককে ভর্তির জন্য খুলনা শিশু হাসপাতালে নেওয়া হয়। করা হয় বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
শাহজাদীর আইনজীবী শেখ রফিকুজ্জামান বলেন, 'মঙ্গলবার মহানগর দায়রা আদালতে জামিনের আবেদন করা হয়। আদালতে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলো উপস্থাপন করা হয়। আদালতের বিচারক মো. শরীফ হোসেন হায়দার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জামিন দেন এবং দ্রুত এই আদেশ কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।'
তিনি বলেন, 'ভুক্তভোগীদের আর্থিক দুরবস্থার বিষয়টি আদালতের নজরে আনলে বেলবন্ডও মওকুফ করেন। দুই আসামির ৬টি বেলবন্ডের জন্য আরও দুই হাজার টাকা খরচ হতো। আদেশের কপি নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা মুক্তির ব্যবস্থা করেন।’
তিনি আরও বলেন, “শুনানিকালে বিচারক বলেছেন, আইনে যাই থাকুক না কেন ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ বিবেচনায় নিয়ে নিম্ন আদালতেই এই মায়ের জামিন দেওয়া উচিত ছিল।”
খুলনা কারাগারের জেল সুপার নাসির উদ্দিন প্রধান বলেন, ‘দুপুর ১টা ২৬ মিনিটে জামিনের কাগজ আমাদের হাতে পৌঁছায়। দুজনের মধ্যে নার্গিস বেগম জেলা কারাগারে ছিলেন। তিনি মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ। এজন্য তাকে মুক্তি দিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ভুক্তভোগীদের আইনজীবী ও পরিবারের সদস্যদের প্রিজন সেলে যেতে বলা হয়। দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটে তিনজনকে মুক্তি দিয়ে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।’
মঙ্গলবার সকাল থেকেই মামলার বাদী মির্জা সুজন শাহজাদীর পরিবারের সঙ্গেই ছিলেন। আদালতেও তিনি উপস্থিত হন। দুপুরে কারামুক্তির পর তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন শাহজাদী। তিনি বলেন, ‘চার মেয়ে নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। আমি আল্লাহকে কখনো দোষারোপ করিনি। মায়ের মাথা ঠিক নেই। তিনি না বুঝেই ফারহানকে বাড়ি নিয়ে গেছে।’
মামলার বাদী মির্জা সুজন বলেন, ‘আমি সব শুনেছি। আমি মামলা চালাব না। আপনি আমাকে মাফ করে দেন।’
পরে মির্জা সুজন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার ছেলে ও শাহজাদী আপার মেয়ে একই দিন জন্ম নেয়। আমার বাচ্চা জন্মানোর পর বুকের দুধ পাচ্ছিল না। তখন শাহজাদী আপা তার মেয়ে ও আমার ছেলেকে একসঙ্গে দুধ খাওয়ান। ওই দিন দুধ খাওয়াতে ফারহানকে কোলে নিয়ে নিচে নামেন তিনি। এরপর হঠাৎ করে দেখি সে কোথাও নেই। ছেলে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে মামলা করি। পরে জেনেছি, নানামুখী চাপ সামলাতে না পেরে শাহজাদীর মা নার্গিস বেগম ফারহানকে বাড়ি নিয়ে যান।’
আইনজীবী শেখ রফিকুজ্জামান বলেন, ‘মানব পাচার মামলা আপোস অযোগ্য। বিষয়টি কিভাবে নিষ্পত্তি করা যায়, সেটি নিয়ে আদালতসহ সবার পরামর্শ প্রয়োজন। মামলার শুনানি ২৫ সেপ্টেম্বর ছিল। শিশুটি অসুস্থ হওয়ায় আদালত শুনানির দিন পরিবর্তন করে আগামী ২০শে অক্টোবর ধার্য করেছেন।’
প্রসঙ্গত, বাগেরহাটের রামপালের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম ও ফকিরহাটের মেয়ে শাহজাদীর সংসারে চার কন্যাশিশু রয়েছে। আবারও অন্তঃসত্ত্বা হন শাহজাদী। অনাগত সন্তান যেন ছেলে হয়–স্বামী ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে প্রত্যাশার চাপ ছিল। কন্যা হলে বিবাহ বিচ্ছেদের হুমকি দিয়েছিলেন স্বামী।
এমন অবস্থায় গত ১১ই সেপ্টেম্বর রাতে সিজারিয়ানের মাধ্যমে ফুটফুটে কন্যাসন্তান জন্ম দেন শাহজাদী। সংবাদ শুনেই হাসপাতাল ত্যাগ করেন সিরাজুল। পরের দিনগুলোতে তিনি আর হাসপাতালে আসেননি, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও রাখেননি।
নানামুখী চাপে দিশেহারা শাহজাদীর মা নার্গিস বেগম ১৫ই সেপ্টেম্বর দুপুরে একই হাসপাতালে জন্ম নেওয়া আরেক রোগীর ছেলে সন্তান চুরি করেন। নবজাতক চুরির সংবাদে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সিসি ক্যামেরা ফুটেজ ও পুলিশের তৎপরতা ওই দিন সন্ধ্যায় ছেলে নবজাতকটি উদ্ধার করা হয়। আটক করা হয় শাহজাদীর মা নার্গিস বেগমকে।
এ ঘটনায় শাহজাদী ও তার মাকে আসামি করে মানব পাচার আইনে মামলা করেন চুরি যাওয়া শিশুর বাবা মির্জা সুজন। ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে নার্গিস বেগমকে কারাগারে পাঠানো হয়। গত ৬ দিন ধরে তিনি কারাগারে রয়েছেন। শাহজাদী একটি কক্ষে পুলিশ প্রহরায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। সঙ্গে ছিল তার শিশুকন্যা। ২১শে সেপ্টেম্বর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। মায়ের কোলে চড়ে কারাগারে যায় ১২ দিনের শিশুটিও। মঙ্গলবার তারা মুক্তি পেলেন।
খবরটি শেয়ার করুন