ছবি: সংগৃহীত
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। এ জন্য সরকারকে শক্ত ভূমিকা নিতে হবে। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন না হলে দেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ারও আশঙ্কা আছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
সরকারের গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ মনে করেন, রাষ্ট্রকাঠামোর ক্ষেত্রে কতগুলো পরিবর্তন নিশ্চিত করার জন্য হবে আগামী জাতীয় নির্বাচন। রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তনগুলোর ব্যাপারে একমত হওয়া না গেলে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ যে জায়গায় যাবে, তাতে মৌলিক কোনো হেরফের ঘটবে না।
আগামী নির্বাচনের জন্য তিনটি পথ আছে বলে মনে করেন আলী রীয়াজ। প্রথমত, নির্বাচনের পূর্বশর্তগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর পূরণ করা; দ্বিতীয়ত, সরকারের দৃঢ় অবস্থান নেওয়া; তৃতীয়ত, সংস্কার, নির্বাচন কিছু না করে বসে থাকা। একসময় ফেব্রুয়ারি আসবে, নির্বাচনও হবে। কিন্তু এরপর কী হবে, তা তিনি বলতে চান না। তার আশঙ্কা, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে কেবল অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে তা নয়, জাতীয় নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হবে।
এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান। তিনি বলছেন, 'নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই রাজনীতিতে উত্তেজনা, অনিশ্চয়তা ও সম্ভাব্য সংঘাতের আভাস স্পষ্ট হচ্ছে।' বিশেষ করে, দেশের আটটি দলের যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা এবং জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলার ঘটনাকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে দেখছেন।
নিজের ইউটিউব চ্যানেল 'জাহেদস টেইক'-এ আপলোড করা এক ভিডিওতে তিনি এসব কথা বলেন। আজ রোববার (১৪ই সেপ্টেম্বর) আপলোড করা এ ভিডিও রাত সাড়ে ৮টার মধ্যে দেখা হয়েছে ৩৩ হাজারের বেশি বার। এ সময়ের মধ্যে এতে মন্তব্য এসেছে ৭৭৯টি। 'নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার নেতৃত্ব জামায়াতের' শিরোনামে তিনি ভিডিওটি আপলোড করেছেন।
জাহেদ উর রহমান ভিডিওতে বলেন, 'গতকালের (শুক্রবার) একটি খবর খুবই সিগনিফিক্যান্ট, আটটি রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এই দলগুলোর মধ্যে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন, চরমোনাইয়ের পীরের দল, খেলাফত মজলিস (দ্বি-ভাগে বিভক্ত), গণঅধিকার পরিষদ (নুরুল হক নুর), এবি পার্টি এবং নেজামে ইসলাম পার্টি। এই দলগুলোর কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দাবি, পিআর (প্রতিনিধিত্ব অনুপাতে আসন বরাদ্দ) বিষয়ক মতপার্থক্য এবং সবচেয়ে বিতর্কিত দাবি, জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের আহ্বান।'
তিনি বলেন, জাতীয় পার্টিই এই মুহূর্তে মূল সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে। আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদী আখ্যা দিয়ে যদি তাদের নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে, তাহলে একই যুক্তিতে তাদের ‘দোসর’ জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নও ওঠে। এই যুক্তি নতুন মাত্রা পেয়েছে। তিনি আরো বলেন, এই দলগুলো একত্রিত হয়ে জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। যদি এই চেষ্টা সফল হয়, তাহলে নির্বাচনি মাঠের ভারসাম্য সম্পূর্ণ পাল্টে যেতে পারে।
তার মতে, জামায়াতের মতো দলগুলোর জন্য এটি কৌশলগত সুবিধা বয়ে আনতে পারে। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে বিএনপির প্রস্তুতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। বিএনপি এখনো তাদের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করেনি, ফলে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মাঠে কাজ করলেও সেই প্রচার কার্যত অনিশ্চয়তার মধ্যে চলছে।
এ বিষয়ে জাহেদ উর রহমান বলেন, নিশ্চিতভাবে প্রচারণা চালানো আর অনিশ্চয়তা নিয়ে মাঠে নামার মধ্যে পার্থক্য আছে। জামায়াত প্রায় ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে এবং তারা মাঠে সক্রিয় রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
জাহেদ উর রহমান বলেন, সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে যদি সংসদ ছাড়াই প্রেসিডেনশিয়াল ডিক্রির মাধ্যমে কিছু সিদ্ধান্ত কার্যকর করার চেষ্টা হয়, তাহলে সেটি একটি বিপজ্জনক নজির তৈরি করবে। বিএনপির এই আপত্তি অযৌক্তিক নয়।
তিনি বলেন, এর আগে এরশাদ পতনের সময় রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একবার এমন নজির স্থাপন হয়েছিল, যেখানে পরবর্তী সময়ে একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রেটিফিকেশন করা হয়। তবে এমন সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর।
সবচেয়ে বড় আশঙ্কার জায়গা হিসেবে তিনি মনে করেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা ও বিশ্বাসহীনতা বাড়ছে। তিনি বলেন, আমরা যে গণতান্ত্রিক পরিবেশের কথা বলছিলাম গত বছরের ৫ই আগস্টের পর, সেখানে সহাবস্থান, বিতর্ক ও মতপার্থক্যের মধ্যে একটা সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। সে আশার বিপরীতে এখন শত্রুতার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, এভাবে রাজনৈতিক দলগুলো যদি পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়, তাহলে বাংলাদেশ একটি গভীর সংকটে পড়তে পারে। এতে উপকৃত হবে শুধু তারা, যারা বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতা চায়। বাংলাদেশে একটি ‘কেওটিক পলিটিক্যাল এনভায়রনমেন্ট’ তৈরি হওয়াটাই ভারতের স্বার্থে কাজ করবে। যদি দেশে বিশৃঙ্খলা বাড়ে, তাহলে আওয়ামী লীগকে তুলনামূলকভাবে ‘স্থিতিশীলতার প্রতীক’ হিসেবে তুলে ধরা সহজ হবে, এটাই হতে পারে ভারতীয় স্ট্র্যাটেজি।
তিনি বলেন, একটি নির্বাচিত সরকার ভারতের কাছে বরাবরই মন্দের ভালো বিকল্প। কিন্তু তার চেয়েও বড় সুবিধা তারা পাবে, যদি বাংলাদেশ রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় ডুবে যায়। সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো যেন শত্রুতার জায়গা থেকে নয়; বরং আলোচনার জায়গা থেকে এগিয়ে আসে। না হলে আমরা নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনব।
তিনি আরো বলেন, এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঢুকে গেলে শেষ পর্যন্ত জিতিয়ে দেওয়া হবে তাদের, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, যারা দেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় অস্থিতিশীলতা তৈরি করে।
খবরটি শেয়ার করুন