ছবি: সংগৃহীত
প্রায় এক যুগ পূর্বেও লবণাক্ততার কারণে ধান চাষ করতে না পেরে ফেলে রাখা জমিতে বছরজুড়ে এখন বিভিন্ন ধরনের সবজি ফলাচ্ছেন বরগুনার তালতলী উপজেলার সওদাগর পাড়া নামক একটি গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক চাষি। লবণাক্ত জমিতে সবজি চাষ করে ভাগ্য ফিরেছে তাদের।
এতে প্রতি বছর শুধু তালতলীর ওই একটি গ্রাম থেকে প্রায় ৭ কোটি টাকার উৎপাদিত সবজি বিক্রি হয় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। বর্তমানে ওই গ্রামটি পরিচিতি পেয়েছে ‘সবজি গ্রাম’ নামে।
জানা যায়, এক সময় তালতলী উপজেলার বড়বগী ইউনিয়নের সওদাগর পাড়া গ্রামের চাষিরা শুধু ধান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তবে জমিতে অধিক পরিমাণ লবণ থাকায় ধানের উৎপাদন ভালো না হওয়ায় লোকসানের মুখে পড়তে হতো এ এলাকার অধিকাংশ চাষিদের। ফলে জীবিকার তাগিদ ও আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে বিকল্প উপায় খুঁজতে শুরু করেন তারা। পরবর্তী সময়ে প্রায় এক যুগ আগে শাহাদাত মাতুব্বর নামে এক স্থানীয় চাষি তার জমিতে বিশেষ পরিচর্যায় বিভিন্ন সবজির চাষ শুরু করেন। পরে বিকল্প হিসেবে সবজি চাষে শাহাদাতের সফলতা দেখে আস্তে আস্তে গ্রামের অধিকাংশ চাষিরাই সবজি চাষ করতে শুরু করেন।
বর্তমানে গ্রামটির সাড়ে ৬০০ হেক্টরেরও বেশি জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করেন স্থানীয় চাষিরা। এতে একদিকে চাষিদের অর্থনৈতিক জীবন মানের উন্নয়ন ঘটেছে। অপরদিকে এলাকার বেকার থাকা অনেকেরই জীবিকা নির্বাহের জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে তালতলীর সওদাগর পাড়ার সবজি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে শীত মৌসুমে চাষিদের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে রয়েছে শিম গাছ। বেড কেটে মাটি উঁচু করে মাচা পদ্ধতিতে বিশেষ পরিচর্যায় লাগানো প্রতিটি গাছেই ঝুলছে প্রচুর পরিমাণ ফুল ও শিম। চাষিদের পাশাপাশি এলাকার অনেক বেকার নারী-পুরুষ দৈনিক পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে ক্ষেত থেকে শিম তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রতিদিন শিম তোলার পর বস্তায় ভরে স্থানীয় পাইকারদের মাধ্যমে তা বিক্রির উদ্দেশ্যে পৌঁছে যায় বরগুনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
নাজনীন বেগম নামে নারী চাষি গণমাধ্যমকে বলেন, আগে আমরা ধান চাষ করতাম এছাড়া আমার স্বামী দিনমজুরের কাজ করতো। কিন্তু ওই সময়ে আয়ের টাকা দিয়ে আমাদের সংসার চলাতে কষ্ট হতো। পরে সবজি চাষে সফলতা দেখে কিছু টাকা জোগাড় করে জমি কিনে ৬০ হাজার টাকা খরচ করে মাটি কেটে সবজি চাষ শুরু করি। এরপর সবজি বিক্রির টাকায় বড় ছেলে মাস্টার্স পাস করেছে, মেঝ ছেলে এসএসসি এবং ছোট ছেলে বর্তমানে ৭ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। সবজি চাষের মাধ্যমে আমাদের ভাগ্যের উন্নতি হয়েছে।
দশ বছর ধরে স্বামীর সঙ্গে সবজি চাষে সমানভাবে কাজ করছেন নুরজাহান বেগম। তিনি বলেন, আমরা আগে ধান চাষ করতাম। তবে ধান চাষে আমাদের তেমন কোনো লাভ হয়নি। গ্রামের একজনকে আমরা সবজি চাষ করতে দেখে আগ্রহী হয়ে ৫০ হাজার টাকায় জমি ক্রয় করে সবজি চাষ শুরু করি। এবছর এক মৌসুমে আমাদের সবজি ক্ষেত থেকে প্রায় তিন লাখ টাকার করলা ও শসা বিক্রি করেছি। এখন ক্ষেতে শিম গাছ রয়েছে, প্রতিদিন বিকেলে পাইকাররা তোলা শিম দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন। পরে সপ্তাহ অন্তর তারা বিক্রির টাকা আমাদের বুঝিয়ে দেয়। বর্তমানে সবজি চাষ করে আগের তুলনায় আমরা ভালোই লাভবান হচ্ছি।
আরও পড়ুন: মিষ্টি আলুর বাম্পার ফলনের আশা কৃষকের
সওদাগর পাড়া গ্রামের চাষিদের ভাগ্য পরিবর্তনের পথপ্রদর্শক কৃষি উদ্যোক্তা শাহাদাত মাতুব্বর বলেন, আমাদের গ্রামে বর্তমানে প্রায় ২২০ জন কমার্শিয়াল সবজি চাষি রয়েছেন। এছাড়া তাদের অধীনে প্রতিদিন দুই থেকে তিনজন লোক বিভিন্ন সবজি ক্ষেতে কাজ করেন। আমাদের এলাকায় এখন প্রায় ৬৫০ হেক্টর জমিতে শিম গাছ রয়েছে। আর এ শিম তোলার কাজে স্থানীয় লোকজন ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের মা-বোনসহ অনেক বেকার তরুণরা কাজ করছেন। দৈনিক ৩০০ টাকা বেতনসহ তাদের খাওয়ার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। বছরে দুইটি মৌসুমে আমাদের এই একটি গ্রাম থেকে বরগুনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৬ থেকে ৭ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের সবজি বিক্রি করা হয়।
বরগুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) কৃষিবিদ সি. এম রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, তালতলী উপজেলার সওদাগর পাড়া নামক গ্রামটি এখন সবজি গ্রামে পরিণত হয়েছে। ওই গ্রামের জমি লবণাক্ত থাকায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শে মাটি কেটে উঁচু করে সবজি চাষ শুরু করেন চাষিরা।
বর্তমানে তালতলীর এই একটি গ্রাম থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বছরে কয়েক কোটি টাকার সবজি সরবরাহ করা হয়। তাদের সফলতা দেখে পার্শ্ববর্তী এলাকাসহ বরগুনার বিভিন্ন এলাকার চাষিরা এখন সবজি চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। আমরা কৃষি বিভাগ এ ধরনের কাজকে সাধুবাদ জানানোর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে সব সময় তাদের সঙ্গে আছি।
এসি/কেবি
খবরটি শেয়ার করুন