১০ই নভেম্বর, শহীদ নূর হোসেন দিবস। বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের এক চিরস্মরণীয় দিন। ১৯৮৭ সালের এই দিনে বুকে লেখা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, আর পিঠে লেখা ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’—এই স্লোগানকে ধারণ করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে ২৬ বছরের নূর হোসেন নামে এক টগবগে তরুণ গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে পুলিশ-বিডিআরের গুলিতে নিহত হন। সেদিন পুলিশের গুলিতে আরো দুজন নিহত হলেও গণতন্ত্রের বার্তা লেখা নূর হোসেনই হয়ে উঠেছিলেন আন্দোলনের প্রতীক।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারকে হটিয়ে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৮৬ সালের ৭ই মে এরশাদ একটি প্রহসনের নির্বাচন দেন, যেখানে জনমতের কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোট ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাতদলীয় জোট তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। স্বৈরাচারবিরোধী সেদিনের সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে সারা দেশ থেকে দলে দলে মানুষ ঢাকায় এসে জড়ো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এভিনিউসহ সচিবালয়ের চারপাশের এলাকা মিছিলে মিছিলে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। জনতাকে ছাপিয়ে একটি মুখই সবার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল, তিনি নূর হোসেন।
তাঁর পায়ে কেডস, পরনে জিন্স প্যান্ট, গায়ের শার্ট কোমরে বাঁধা। খালি গায়ে বুক ও পিঠে লেখা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’ গোটা শরীরটাই যেন একটা ত্রিমাত্রিক পোস্টার। তরুণটি মিছিলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলছিলেন। আর সূর্যের আলোর মতো প্রতিফলিত হয়ে উঠেছিল তাঁর বুক ও পিঠ।
নূর হোসেনের প্রতি স্বৈরশাসকের পেটোয়া বাহিনী এতটাই ক্ষুব্ধ ছিল যে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও তাঁকে কোনো চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। নূর হোসেনের পেটের ডানপাশে গুলি লেগেছিল। তাঁর সহযোদ্ধারা যখন তাঁকে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তখন পুলিশ রিকশা থেকে দুই পা ধরে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। নূর হোসেনকে গোপনে রাতের অন্ধকারে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। জীবন্ত নূর হোসেন থেকে মৃত নূর হোসেন স্বৈরশাসকদের কাছে অনেক বড় আতঙ্ক তৈরি করেছিল। নূর হোসেনকে যখন জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়, তখন কেরোসিন দিয়ে তাঁর শরীর থেকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’—স্লোগানটি তুলে ফেলার চেষ্টা করেছিল সামরিক শাসকের পুলিশ বাহিনী। কিন্তু তারা তা শত চেষ্টা করেও মুছে ফেলতে পারেনি। নূর হোসেন স্লোগান নিয়েই কবরে গেছেন। গণতন্ত্রকে ধারণ করেই তিনি কবরে শুয়ে আছেন।
নূর হোসেনের আত্মত্যাগের কারণে আন্দোলনের গতি বাড়তে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে এরশাদ এক মাসের মধ্যে অর্থাৎ ৬ই ডিসেম্বর সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। ১৯৮৮ সালের ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বড় কোনো দল অংশগ্রহণ করেনি। যার কারণে ওই সংসদ রাজনৈতিক বৈধতা পায়নি। নূর হোসেনের আত্মত্যাগে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন আস্তে আস্তে গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর স্বৈরশাসক এরশাদের পতন ঘটে। দীর্ঘ ১৫ বছর পর আবার গণতান্ত্রিক ধারা চালু হয়। জনগণ ফিরে পায় ভোট ও ভাতের অধিকার। আর শহীদ নূর হোসেন হয়ে ওঠেন গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক।
নূর হোসেন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে চিরস্মরণীয় নাম। সেদিন সমবেত জনতার চোখ বারবার তাঁর বুক ও পিঠে আটকে ছিল। এই ধরনের জীবন্ত পোস্টার এর আগে কেউ কখনো দেখেনি। তৎকালীন প্রেক্ষাপটে এই ধরনের জীবন্ত পোস্টার সব পোস্টারকে হার মানিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি যে স্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন, সেই জিরো পয়েন্টের নামকরণ করা হয়েছে নূর হোসেন স্কয়ার। তাঁর গায়ে লেখা স্লোগানটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতিবছর ১০ই নভেম্বর যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘শহীদ নূর হোসেন দিবস’ পালন করা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচিতে দিবসটি পালন করে থাকে। আজকের দিনে শহীদ নূর হোসেনের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
আই.কে.জে/