দ্বিজাতি তত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের অখণ্ডতা থাকছে না এবং সামরিক জান্তাদের হস্তক্ষেপের ফলে জিন্নাহর সৃষ্ট এই রাষ্ট্রটির মৃত্যু যে অনিবার্য, তা একাত্তরের মার্চের প্রথম সপ্তাহে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সাংবাদিক ডেভিড লুসাক।
একাত্তরের ৮ই মার্চ লন্ডনের ‘দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ' পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পুরাতন পাকিস্তানের ইতি’ শিরোনামে একটি রিপোর্টে তিনি এই মন্তব্য করেন। ঢাকা থেকে পাঠানো এই রিপোর্টে বলা হয়, অসংখ্য মানুষের রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় ধ্যান-ধারণায় ভিত্তি করে ভারত বিভাগ ও পাকিস্তানের সৃষ্টি এবং গত কয়েক যুগের অযোগ্য নেতা ও ক্ষমতালোভী সামরিক জান্তাদের হস্তক্ষেপের ফলে জিন্নাহর সৃষ্ট রাষ্ট্রটির মৃত্যু অনিবার্য।
সংসদ অধিবেশন ডাকা ও না ডাকা নিয়ে সৃষ্ট বিরোধের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি লেখেন, 'গত দুই সপ্তাহে রাজনীতি যেভাবে ঘুরপাক খেয়ে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে সাময়িকভাবে এটাকে ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব হলেও ১২০ মিলিয়ন পাকিস্তানির, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের ৭০ মিলিয়ন শোষিত, দরিদ্র বাঙ্গালিদের ভবিষ্যত খুবই অন্ধকারাচ্ছন্ন।'
রিপোর্টে আরো মন্তব্য করা হয়, পূর্ব অঞ্চলের স্বীকৃত জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান কোনো রক্তপাত ছাড়া বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যা দূরীকরণে সচেষ্ট হলেও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মার্শাল ল' কতৃপক্ষকে যথেষ্ট নাজেহাল হতে হয়। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম রাষ্ট্রের দুই নেতার মধ্যে যে কোনো সমঝোতাই হোক না কেন, দুটি দেশকে একটি দেশে পরিণত করার সম্ভাবনা খুবই কম। পাকিস্তানের জন্য এটা নিরেট সত্য কথা।
লুসাক লেখেন ‘এখন এটা দুটি জাতির দেশ। দুটি জাতির আচার-আচরণ, খাদ্য ও ভাষা এক নয়। তাই ধর্মের বন্ধন দুটি জাতিকে একীভূত করে রাখতে পারেনি।’
রিপোর্টের শেষ অংশে ডেভিড লুসাক মন্তব্য করেন, 'কোনো আধুনিক জাতি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও কৃষ্টিগতভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলে কোনো কর্মকাণ্ডই পরিপূর্ণ কার্যকর করা সহজ নয়। পাকিস্তানি নেতারা দেশে স্থায়ীভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'সে কারণে দেশটিকে (পাকিস্তান) দুটি আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত করা ছাড়া এ সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান দেখা যায় না।' পাকিস্তানের তখনকার পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি লেখেন, 'বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে মনে হয়, নেতাদের পূর্বস্থানে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।'
১৯৪৭ সালের পর থেকে পশ্চিম পাকিস্থান পূর্ব পাকিস্তানকে প্রকৃতপক্ষেই একটি কলোনি হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল। বর্তমানে প্রথমবারের মতো তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিজেদের অধিকার ফিরে পেয়েছে বলে লুসাক তার রিপোর্টে উল্লেখ করেন।
পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার পরিস্থিতির জন্য লুসাক ইয়াহিয়া খানকে দায়ী করে লেখেন, 'জাতির এমন একটা সংকটময় মুহূর্তে ইয়াহিয়া খানের অসংযত কথা পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে তোলে। জাতীয় সংসদের অধিবেশন ১লা মার্চের পরিবর্তে ২৫শে মার্চ রেডিওতে দেওয়া ঘোষণায় সবাই সন্দেহ প্রকাশ করেন।'
তৎকালীন আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের কাছে কিসিঞ্জারের ঘনিষ্ঠ সহকারী জোসেফ সিসকোর একটি বার্তায়ও পাকিস্তানের অখণ্ডতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছিল। বার্তাটির উপসংহারে স্পষ্ট করে লেখা ছিল, পাকিস্তানের উভয় অংশের অখণ্ড থাকার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। দুইয়ের মধ্যে রিকনসিলিয়েশনের সুযোগ স্পষ্টতই মুছে গেছে। বিশিষ্ট সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের একটি লেখা থেকে জানা গেছে, একাত্তরের ২রা মার্চ সিসকো রজার্সের কাছে বার্তটি পাঠান।
বাংলা একাডেমির পুরষ্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক ও কবি আবুল মোমেন ডেভিড লুসাকের এই রিপোর্ট প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা ঠিক একাত্তরের প্রথম দিক থেকে পরিস্থিতি খুবই খারাপ হতে থাকে। বিশেষ করে, ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অধিবেশন বন্ধ করে দেওয়ার পর সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে ওঠে। জাতীয় সংসদের অধিবেশন ১লা মার্চের পরিবর্তে ২৫শে মার্চের ঘোষণায় সন্দেহ আরো প্রকট হয়ে ওঠে।'
তিনি বলেন, 'এর আগে পার্লামেন্ট বন্ধের ঘোষণায় বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটার পর সারাদেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় ৭ই মার্চের জনসভা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে বাঙ্গালিদের ভবিষ্যত অর্থাৎ, গন্তব্য স্পষ্ট হয়ে যায়।'
আবুল মোমেন বলেন, 'সেই সময়ের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে অনেকেই প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।' সাংবাদিক ডেভিড লুসাকের মন্তব্য পরবর্তী সময়ে সত্য প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'লুসাক অভিজ্ঞ সাংবাদিক ছিলেন। তার পরিস্থিতি অনুধাবন করার ক্ষমতা ভালো ছিল।'
শুধু লুসাক নয়, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ও পরে বিদেশি অনেক সাংবাদিক বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের রিপোর্ট লিখেছেন উল্লেখ করে আবুল মোমেন বলেন, 'তাদের এসব রিপোর্টে বিদেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা যেমন জোরালো হয়েছে, তেমনই আন্দোলনরত বাঙ্গালিরাও উদ্দীপ্ত হয়েছেন।'
কেসি/এইচ.এস