রবিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৭ই বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পহেলা বৈশাখ বাঙালির সবচেয়ে বড় সর্বজনীন উৎসব

সম্পাদকীয়

🕒 প্রকাশ: ০৫:৪৪ অপরাহ্ন, ১৪ই এপ্রিল ২০২৫

#

ছবি: সংগৃহীত

বাংলা বারো মাসের মধ্যে প্রথম বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ। ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য শুরুর পর থেকে আরবি বছরে হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় হতো। কিন্তু হিজরি সাল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি ফলনের সঙ্গে এর মিল পাওয়া যেত না। তখন সম্রাট আকবর এর সুষ্ঠু সমাধানের জন্য বাংলায় বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেন।

সম্রাটের আদেশ অনুযায়ী সে সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌর বছর ও আরবি হিজরি সালের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম তৈরির কাজ শুরু করেন। বাংলা বছর নির্ধারণ নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। অনেকের মতে, সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের তারিখ ১৫৫৬ সালের ৫ই নভেম্বর থেকে গণনা কার্যকর হয়। প্রথমে ফসলি সন বলা হলেও পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পায়।

বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাঙালিদের যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন রাখার সুবিধার্থে সব জায়গাতেই খ্রিস্টীয় সনের ব্যবহার চালু থাকে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল নববর্ষ উদযাপন হয়। বাংলা একাডেমির নির্ধারিত পঞ্জিকা অনুযায়ী এ তারিখকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বাংলা দিনপঞ্জির সঙ্গে হিজরি ও খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে।

তা হলো- হিজরি সন চলে চাঁদের সঙ্গে আর খ্রিস্টীয় সাল চলে ঘড়ির সঙ্গে। এ কারণে হিজরি সনের নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনের মধ্য দিয়ে, খ্রিস্টীয় দিন শুরু হয় মধ্য রাতে আর ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে বাংলা সনের শুরু হয়।

ঢাকার রমনা পার্কের বটমূলে বর্ষবরণের মূল আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। তবে রমনা থেকে আরম্ভ হয়ে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অনুষ্ঠান বিস্তৃত থাকে।

পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জাতিই নিজের ইতিহাস সংস্কৃতিকে বরণের জন্য বিশেষ দিনকে স্মরণীয় করে রাখে। যেমন, প্রাচীন আরবীয়রা ‘ও কাজের মেলা’, ইরানিরা ‘নওরোজ উৎসব’ ও প্রাচীন ভারতীয়রা ‘দোলপূর্ণিমা’ উদযাপন করতেন। উল্লেখ্য, ইরানিরা এখনো অনেক ঘটা করে নওরোজ উৎসব উদযাপন করেন।

পাকিস্তান আমলে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে সব সময়ই বাঙালি সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হতো। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও গান প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির প্রতিবাদে ১৯৬৫ সালে (১৩৭৫ বঙ্গাব্দে) ছায়ানট নামের একটি সংগঠন রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ উৎসব উদযাপনের আয়োজন করে।

নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে রবীন্দ্রনাথের 'এসো হে বৈশাখ... এসো, এসো...' গানের মাধ্যমে শুরু করে আয়োজন। ১৯৭২ সালের পর থেকে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি পায়। ১৯৮৯ সালে বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে একধাপ বাড়তি ছোঁয়া পায় বাংলা নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠান। প্রতি বছরই তাই অসংখ্য বাঙালির অপেক্ষা থাকে কবে আসবে বাংলা নববর্ষ।

বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো পান্তা-ইলিশ। বাস্তবতা এমন যে, পান্তা-ইলিশ না হলে আর পহেলা বৈশাখের কোনো আমেজই যেন থাকে না। প্রতিটি বাড়িতে বা ঘরে ঘরে পান্তা-ইলিশ থাকতে হবে। যেসব স্থানে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান হয়, সেখানে অবধারিতভাবে পান্তা-ইলিশের আয়োজন থাকে। তা না হলে নববর্ষ উদযাপন যেন পরিপূর্ণ হয় না। অথচ পান্তা বাঙালির সংস্কৃতি হলেও ইলিশ আপামর জনগণের খাদ্য নয়।

মঙ্গল শোভাযাত্রা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানমালায় ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। ১৯৮৯ সালে এ শোভাযাত্রার প্রচলন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। পহেলা বৈশাখের দিন সকাল গড়িয়ে যখন রমনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ও শাহবাগে মানুষের উপচেপড়া ভিড় থাকে, তখন শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। বর্ষবরণের মঙ্গল শোভাযাত্রার আনন্দে ছেলে-বুড়ো সবাই তখন মেতে ওঠেন।

নবর্বষের আরেকটি অনুষঙ্গ হলো হালখাতা। প্রাচীনকাল থেকে বর্ষবরণের রীতির সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবেই জড়িত সেটা। প্রত্যেকে চাষাবাদ বাবদ চৈত্র মাসের শেষদিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতেন। এর পরের দিন, অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা তাদের প্রজা সাধারণের জন্য মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা রাখতেন।

যা পরবর্তীতে ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। দোকানিরা সারা বছরের বাকির খাতা সমাপ্ত করার জন্য পহেলা বৈশাখের দিনে নতুন সাজে দোকানে বসে থাকেন। গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে শুরু করেন নতুন বছরের ব্যবসা। এ উৎসবগুলো সামাজিক রীতির অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে। এখনো গ্রামগঞ্জের হাট-বাজারগুলোতে নববর্ষে হালখাতার হিড়িক পড়ে।

নববর্ষ এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এ দিনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই বাংলা বছরের প্রথমদিনকে বরণের আনন্দে মাতোয়ারা থাকেন। সব অশুভ শক্তিকে পেছনে ফেলে নতুন দিনের শুভ সূচনা হোক, শুভ নববর্ষ -১৪৩২ বঙ্গাব্দ।

এইচ.এস/

বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন