চলতি বছরের ৫ই আগস্ট বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘জুলাই সনদ’ পাঠ করেন। সেদিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। যদিও তার আগে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে এক বৈঠকের পর এক যৌথ ঘোষণায় জানানো হয়েছিল—নির্বাচন রমজানের এক সপ্তাহ আগে অনুষ্ঠিত হতে পারে। সাধারণ হিসাবে, যদি রমজান শুরু হয় ১৯শে ফেব্রুয়ারি, তবে তার এক সপ্তাহ আগের দিন হয় ১২ই ফেব্রুয়ারি, যা বৃহস্পতিবার। এ কারণেই অনেকেই ধরে নেন, ১২ই ফেব্রুয়ারিই হতে পারে নির্বাচনের সম্ভাব্য দিন।
তবে এটিকে একটি স্পষ্ট ও চূড়ান্ত ঘোষণা হিসেবে ধরা যায়নি। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছিল। কেউ কেউ বলছিলেন, ড. ইউনূস হয়তো বিএনপিকে বোঝাতে বা আশ্বস্ত করতেই এমন ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু যখন মালয়েশিয়া সফরেও তিনি ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন এবং তার দপ্তর থেকে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়—তখন অনেকের মধ্যেই বিশ্বাস জন্ম নেয় যে, প্রধান উপদেষ্টা সত্যিই নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে আন্তরিক।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ কামাল তার ইউটিউব চ্যানেল ‘কথা’-তে গতকাল বুধবার (১৩ই আগস্ট) প্রচারিত ভিডিওতে এসব মন্তব্য করেন। আজ বৃহস্পতিবার (১৪ই আগস্ট) বেলা ১২টা পর্যন্ত ভিডিওটির ভিউ সংখ্যা ছিল ৯১ হাজারেরও বেশি। তার আলোচনার সারসংক্ষেপে ফুটে উঠেছে—বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এখন কতটা অভ্যন্তরীণ, আর কতটা আন্তর্জাতিক—যা নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।
নাসির উদ্দিন পাটোয়ারীর বিতর্কিত মন্তব্য
গত মঙ্গলবার (১২ই আগস্ট) বিকেলে রাজধানীর খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে জাতীয় যুবশক্তির সম্মেলনে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ঘোষণা দেন, ‘নির্বাচনের তারিখ ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণা করা হলেও, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হবে না!’ তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন করতে হবে, বিচার, সংস্কার করতে হবে—এসব না হলে এনসিপি নির্বাচন হতে দেবে না।
নাসির উদ্দিন পাটোয়ারীর বক্তব্যে ঘিরে মাসুদ কামাল প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কে? আপনি কি নির্বাচন কমিশনের কেউ? আপনি কি সরকারের কেউ, না কি এমন কোনো ব্যক্তি যিনি প্রধান উপদেষ্টার চেয়েও বেশি বোঝেন বা ক্ষমতা রাখেন?’
এনসিপির সক্ষমতা ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
এখানেও প্রশ্ন তোলেন মাসুদ কামাল—‘বাংলাদেশের বাস্তবতায় এনসিপির এই বক্তব্য বাস্তবায়নের সক্ষমতা আছে কি?’ ওই বক্তব্য এনসিপি দেয় একটি যুব সম্মেলনে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি। তার সামনে এনসিপির নেতারা এসব কথা বলেন।
মাসুদ কামাল দাবি করেন, এই বক্তব্যের আগের দিন গত সোমবার (১১ই আগস্ট) এনসিপির নেতারা বৈঠক করেন ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গে। সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন—এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্যসচিব আখতার হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা ও যুগ্ম সদস্যসচিব আলাউদ্দীন মোহাম্মদ। রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে হয় এই বৈঠক।
‘পাঠা নাচে খুঁটির জোরে’–বৈঠকের পরদিনই হঠাৎ ভাষা বদল
মাসুদ কামাল প্রশ্ন তোলেন—‘এনসিপির সঙ্গে আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের বৈঠক কেন? এনসিপি কি সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল? তাদের সঙ্গে কেন এমন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা?’ তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, বৈঠকের ঠিক পরদিন এনসিপির বক্তব্য বদলে যাওয়াটা তাৎপর্যপূর্ণ এবং এতে আমেরিকার ভূমিকার প্রশ্ন উত্থাপন হয়।
তিনি বলেন, ‘‘বৈঠকের পরদিন এই ভাষায় কথা বলা, এই আত্মবিশ্বাস বা অহংকার কি সেই বৈঠকের ফল? গ্রামে একটা কথা আছে, ‘পাঠা নাচে খুঁটির জোরে’। আমি সেই খুঁটিটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।’’
ড. আলী রিয়াজ- মনির হায়দারের দ্বৈত নাগরিকত্ব ও ভূমিকা
মাসুদ কামাল আরও উল্লেখ করেন, গত মঙ্গলবার (১২ই আগস্ট) বিকেলে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রিয়াজ ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ প্রতিনিধি মনির হায়দার। ড. আলী রিয়াজ আমেরিকার নাগরিক এবং একজন শিক্ষক। মনির হায়দারও দ্বৈত নাগরিক। তারা উভয়েই আমেরিকায় বসবাস করেন, সংসার করেন, এবং সেখানে শপথ করেছেন আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা করবেন।
তাদের এই বৈঠক নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মাসুদ কামাল—‘বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তারা নিজ দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কী আলোচনা করলেন? তারা কী শুনতে গেছেন—আর কী করলে আমেরিকার স্বার্থ সংরক্ষণ করা যাবে?’
সংস্কার বিলম্ব মানেই নির্বাচন বিলম্ব?
ড. আলী রিয়াজের নেতৃত্বে সংস্কার প্রক্রিয়া কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে, এবং মাসুদ কামাল আশঙ্কা করেন যে, এই বিলম্বটাই হয়তো উদ্দেশ্যমূলক—নির্বাচন পিছিয়ে দিতে একটি কৌশল। আর এনসিপি সেই একই সুরে বলছে—সংস্কার না হলে নির্বাচন হবে না।
সব মিলিয়ে, মাসুদ কামালের মতে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হওয়া নিয়ে এখন নতুন করে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। দেশ শাসন এখন কারা করছে, আর ভবিষ্যতে কারা করবে—এটাই এখন মূল প্রশ্ন।
খবরটি শেয়ার করুন