ফাইল ছবি
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে চায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাবক পশ্চিমা শক্তিগুলো। দেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া আপাতত অসম্ভব মনে হলেও দলটির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পর্দার আড়ালে সক্রিয় রাজনীতির দেশি-বিদেশি প্রভাবকেরা। তারা ইতিমধ্যে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠদের কাছে দুটি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। প্রস্তাবগুলোতে কী আছে, উত্তরে শেখ হাসিনা কী বলেছেন সেসব নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মানবজমিন।
পত্রিকাটির জন্য প্রতিবেদনটি লিখেছেন খোদ এর প্রধান সম্পাদক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী। তবে শেখ হাসিনার বিষয়ে ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকারের যে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির কথা তুলে ধরেছেন তিনি, এর সঙ্গে একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক দ্বিমত প্রকাশ করেছেন সুখবর ডটকমের কাছে। তারা বলছেন, ২০২৪ সালের ৫ই আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে চলে যাওয়ার দিন শেখ হাসিনার বিষয়ে ভারতের যে রাজনৈতিক অবস্থান ছিল, সেখানে পরিবর্তন তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বরং, আওয়ামী লীগের গত সরকারের আমলে ভারত বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্কে যে মনোভাব পোষণ করত, সেখানে আজও তেমন পরিবর্তন ঘটেনি।
তাছাড়া শেখ হাসিনার সম্পর্কে ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তনের বিষয়ে ভারতীয় কোনো কূটনৈতিক সূত্রের কথাও মতিউর রহমান চৌধুরীর প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিবিসি বাংলা ও টাইম ম্যাগাজিনসহ আন্তর্জাতিক অন্যান্য গণমাধ্যমের দাবি অনুযায়ী, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার প্রায় চার মাস পর থেকে বিদেশে বিভিন্ন স্থানে জনসম্মুখে বক্তব্য দেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যা তার আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার ইঙ্গিত।
যদিও তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা চলছে। যা অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফয়সালা হয়ে যাবে। গণ-অভ্যুত্থানের সময় গণহত্যার মামলায় তাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে, একাধিক অভিযোগে তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হতে পারেন। তাদের দাবি, শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ সবার মধ্যে এমন একটি ধারণা দৃঢ় ছিল যে ৭৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ সভাপতির বাকি জীবন কাটবে নির্বাসিত অবস্থাতেই। কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং তার পরবর্তী ফলাফল দেশে-বিদেশে শেখ হাসিনার এমন নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেছে যে, দেশের রাজনীতিতে তার ফেরা আর সম্ভব হবে না।
তবে সম্প্রতি এই ধারণা বা বিশ্বাস ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাওয়ার অবস্থাও তৈরি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতির যে নেতৃত্বশূন্যতা, সেটিই একসময় স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে আসার পথ এবং রাজনীতি করার সুযোগ তৈরি করে দেবে। আজ বৃহস্পতিবার (২৫শে) মানবজমিনের অনলাইন সংস্করণে মতিউর রহমান চৌধুরীর প্রতিবেদনটি প্রচারিত হয়, 'হাসিনার ফেরা এবং আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ' শিরোনামে।
এতে তিনি বলেন, 'একাধিক কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন আয়োজন করতে হলে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ অনেকটাই জরুরি। কারণ, তাদেরও ভোট রয়েছে। তাছাড়া, ভবিষ্যৎ সামনে রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ। এই অবস্থায় আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়া তাদের পক্ষে আইনত সম্ভব হবে না। এ কারণেই কূটনীতিকরা বলছেন, বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে শেখ হাসিনার ভাবা উচিত। বাংলাদেশের স্থিতি নিশ্চিত করতে হলে সবদলের অংশগ্রহণ আবশ্যক।'
তিনি বলেন, 'কোনো প্রস্তাবেই সায় দিচ্ছেন না ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সামনে দুটি প্রস্তাব। এক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আপনাকে নিয়ে পুনরায় আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করা সম্ভব নয়। কারণ, বাংলাদেশের মানুষ আপনার বিপক্ষে চলে গেছে। যেমনটা হয়েছে ভারতের বেলায়। গণহত্যা চালানোর দায় আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না।'
তিনি লেখেন, 'আপনার (শেখ হাসিনা) বিরুদ্ধে ট্রাইবুন্যালে মামলা চলছে। যা অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফয়সালা হয়ে যাবে। যে মামলায় আপনাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। দালিলিক প্রমাণসহ একাধিক অভিযোগে আপনি দণ্ডপ্রাপ্ত হতে পারেন। এই অবস্থায় আপনার দেশে ফেরা খুব কঠিন। মিরাকল কিছু না ঘটলে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না।'
মতিউর রহমান চৌধুরী লিখেন, 'তাই দ্বিতীয় প্রস্তাবটি বিবেচনা করে দেখতে পারেন (শেখ হাসিনা)। প্রস্তাবটি হচ্ছে, অন্য কাউকে দায়িত্ব দিতে পারেন। তাতে করে আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানো সহজ হবে। যেমনটা হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। বাকশাল গঠন করে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করা হয়েছিল। ১৫ই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বাকশালের সমাপ্তি ঘটে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পুনরায় দল গঠনের সুযোগ দেন। জোহরা তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংগঠিত হয়।'
তিনি বলেন, 'দুটি পশ্চিমা শক্তি অতি সম্প্রতি এই প্রস্তাব দিয়ে হাসিনা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছে। এমনকি ভারতের অনেকেই মনে করছেন, এটাই এই মুহূর্তের বাস্তবতা। ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও এ নিয়ে রয়েছে প্রচণ্ড মতবিরোধ। কেউ কেউ বলছেন, হাসিনাকে রাখতে গিয়ে গোটা বাংলাদেশকেই আমরা হারিয়েছি। এর মধ্যে অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। বৃহৎশক্তিও নেই আমাদের সঙ্গে। ভূ-রাজনৈতিক কারণটাও বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার মতও দিচ্ছেন অনেকে।'
তিনি আরো বলেন, 'তিনি (শেখ হাসিনা) মনে করছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস চলে গেলে তার ফেরাটা খুবই সহজ হবে। ঢাকায় বলাবলি আছে, একটি রাজনৈতিক শক্তি তলে তলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। অভ্যুত্থানের পর এদের এক শীর্ষ নেতা ক্ষমা করার প্রসঙ্গটি সামনে আনেন। ৩রা সেপ্টেম্বর ২০২৪, ওই শীর্ষ নেতা বলেছিলেন, আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। রাজনৈতিকভাবে আমাদের ওপর যারা জুলুম-নির্যাতন করেছে আমরা তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি।'
এদিকে নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষক এবং বাংলাদেশের নাগরিক মোবাশ্বের হাসান এ প্রসঙ্গে গত বছরের অক্টোবরে টাইম সাময়িকীকে বলেন, ‘বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকারের বৈধতা রয়েছে, জনসমর্থনও রয়েছে; কিন্তু এই সরকার নির্বাচিত নয়। এই সরকারের কোনো ম্যান্ডেট নেই। শেখ হাসিনা যদি চান, তাহলে এই দুর্বলতাকে ব্যবহার করে একসময় দেশে ফিরে আসতে পারবেন। এটা শুধুই সময়ের অপেক্ষা।’
আমেরিকার থিংকট্যাংক সংস্থা উইলসন সেন্টারের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যানও এমনটা মনে করেন। টাইম সাময়িকীকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন শুধু সম্ভবই নয়, খুবই সম্ভব। কারণ পরিবারতন্ত্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। যুগ যুগ ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় এটি চলে আসছে। মাত্র একটি বাংলাদেশে এই সংস্কৃতির অবসান ঘটবে—এমনটা প্রত্যাশা করা যায় না। তারপরও হয়তো বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যেত, যদি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হতো। কিন্তু দেশটির যে রাজনৈতিক বাস্তবতা, তাতে এটি একেবারেই সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ এখনো বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।’
বাংলাদেশের থিংকট্যাংক সংস্থা সেন্টার ফর গভার্নেন্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান টাইম ম্যাগাজিনকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যে পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা দেশ থেকে বিদায় নিয়েছেন এবং তার চলে যাওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে আগামী এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকবে—তা একেবারেই ভিত্তিহীন কল্পনা। তবে এই সরকার যদি সার্বিকভাবে ভেঙে পড়ে, তাহলে যেকোনো কিছুই সম্ভব।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভেঙে পড়ার আশঙ্কা বেশ ভালোভাবেই রয়েছে বলে মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক শহীদুল হক।
টাইম ম্যাগাজিনকে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। ১৫ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের পুরো আমলাতন্ত্র ও প্রশাসনকে নিজের মতো করে সাজিয়েছে দলটি। বর্তমান সরকার কয়েকজন চিহ্নিত আমলা ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু পুরো প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো এই সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া প্রশাসন ঢেলে সাজাতে গেলে আমলাতন্ত্রের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে। অন্তর্বর্তী সরকার পারতপক্ষে কোনোভাবেই এ ঝুঁকি নিতে চাইবে না। এই প্রশাসন এবং আমলাতন্ত্রই আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনাকে ফের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনবে।’
খবরটি শেয়ার করুন