বুধবার, ৩০শে জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১৫ই শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সর্বশেষ

*** সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্তের আহ্বান সিপিজের *** সেপ্টেম্বরে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে পারে ব্রিটেনও *** একাত্তর নিয়ে বক্তব্য, সমালোচনার মুখে আসিফ নজরুলের দুঃখ প্রকাশ *** জুলাই সনদের খসড়ার সঙ্গে ‘মোটামুটি’ একমত বিএনপি *** বিনা অনুমতিতে নূরুল কবীরকে প্রেস কাউন্সিলের সদস্য করা হয়েছে, প্রত্যাহারের অনুরোধ *** জনসংখ্যা বাড়াতে প্রত্যেক শিশুকে বছরে ৬২ হাজার টাকা করে দেবে চীন *** প্রেস কাউন্সিলের সদস্য হলেন মাহফুজ আনাম, নূরুল কবীরসহ ১২ জন *** ইসরায়েলি দুই মন্ত্রীকে নেদারল্যান্ডসে ঢুকতে দেবে না দেশটির সরকার *** ডাকসু নির্বাচন ৯ই সেপ্টেম্বর *** আর কাউকে প্রতীকী মূল্যে জমি দেবে না সরকার: অর্থ উপদেষ্টা

উপদেষ্টা আসিফের বাবা বাংলাভিশনের বিশেষ অনুসন্ধানে...

নিজস্ব প্রতিবেদক

🕒 প্রকাশ: ১১:৫৭ অপরাহ্ন, ২৯শে জুলাই ২০২৫

#

আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও ইশরাক হোসেন। ছবি: সংগৃহীত

কুমিল্লার মুরাদনগরের আকুবপুর ইয়াকুব আলি ভূঁইয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক শিখা রাণী রায়কে শারীরিক নির্যাতন করে পদত্যাগে বাধ্য করানোর চেষ্টা করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতারা। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শিখা রাণী দলবদ্ধ সহিংস আক্রমণের শিকার হন। তার অভিযোগ, তাকে ওই বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে আটকে রেখে প্রথমে পদত্যাগের জন্য চাপ দেওয়া হয়। দীর্ঘ ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ওই কক্ষে অবরুদ্ধ রেখে বিবস্ত্র করে চালানো হয় নির্যাতন। পরে তাকে বিদ্যালয় থেকে বের করে ঘোরানো হয় গ্রামের প্রধান সড়কগুলোতে।

এ ঘটনার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যা পরে ভাইরাল (আলোচিত) হয়। ভিডিওতে শিখা রাণীকে হেনস্থাকারীদের দলে অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং  যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বাবা এবং ওই বিদ্যালয়েরই প্রধান শিক্ষক বিল্লাল হোসাইনকে দেখা যায় বলে অনেকে অভিযোগ করেন। ঘটনাটি গত বছরের ১৭ই সেপ্টেম্বরের।

শিখা রাণী রায় আমেরিকার নিউইয়র্ক-ভিত্তিক একটি অনলাইন নিউজপোর্টালের টকশোতে দেওয়া বক্তব্যে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর জন্য উপদেষ্টা আসিফের বাবা বিল্লালকে দায়ী করেন। বিদেশি সংবাদমাধ্যমে তিনি এ রকম বক্তব্য দেওয়ায়, বা বক্তব্যে উপদেষ্টার বাবাকে অভিযুক্ত করার প্রতিবাদে মুরাদনগরে 'মানববন্ধন' অনুষ্ঠিত হয়। সামাজিক মাধ্যমে অনেক নেটিজেন ওই মানববন্ধন আসিফ মাহমুদের বাবার 'ইন্ধন-ইশারায়' অনুষ্ঠিত হয় বলে অভিযোগ করেন।

শিখা রাণী উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদেরও শিক্ষক। তাকে নির্যাতনের আলোচিত ওই ভিডিও বেসরকারি টিভি চ্যানেল বাংলাভিশনের একাধিক সাংবাদিকের চোখে পড়ে। টিভি চ্যানেলটির ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মুরাদনগরের বিভিন্নভাবে ভুক্তভোগী কয়েকজন প্রতিবেদন করানোর আশায় যোগাযোগ করেন। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন সাজায় চ্যানেলটি, এর শিরোনাম 'উপদেষ্টা আসিফের বেপরোয়া বাবা'। প্রতিবেদনটিতে ভুক্তভোগী, বা অভিযোগকারীদের বক্তব্য, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুযায়ী তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরে চ্যানেলটি।

প্রতিবেদনটি বাংলাভিশনের 'ক্রাইম অ্যান্ড করাপশনের' ২৩তম পর্বে আজ মঙ্গলবার (২৯শে জুলাই) প্রচারিত হয়। এটি গতকাল সোমবার রাতে প্রচারের পরিকল্পনা থাকলেও প্রস্তুতি ঘাটতির কারণে মঙ্গলবার সকাল ১০টায় প্রচারিত হয় বলে সুখবর ডটকমকে জানান এর উপস্থাপক ও সাংবাদিক সুজন মাহমুদ। এটি টিভিতে প্রচারিত হওয়ার পর বাংলাভিশনের ইউটিউব চ্যানেলেও আপলোড হয়।

এরপর সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। প্রতিবেদনটি ইউটিউবে আপলোড হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই ভাইরাল যায়। ফের আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন আসিফ মাহমুদের শিক্ষক বাবা, বরাবরের মতো এবারও তিনি নেতিবাচক সংবাদেরই শিরোনাম। অবশ্য বাংলাভিশনের ওই প্রতিবেদনের অভিযোগকারীদের বক্তব্য বা ঘটনার সত্যতার বিষয়ে স্বাধীনভাবে কোনো যাচাই ও অনুসন্ধান করতে পারেনি সুখবর ডটকম।

তবে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদের নেতৃত্বে মুরাদনগরে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী আছে, যারা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের 'বিরোধিতাকারী' হিসেবে পরিচিত। তারা এ উপদেষ্টার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিলসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করেন। উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে কয়েকবার মিছিলও করেন। তারা বিভিন্ন অপপ্রচার করে আসছেন বলে উপদেষ্টাও গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন। আর বিএনপির এসব নেতাকর্মীর মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে এলাকায় নানা অভিযোগ আছে। উল্লেখ্য, কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসন থেকে পাঁচবারের নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য কায়কোবাদ।

বাংলাভিশনের প্রতিবেদনটি প্রচারিত হওয়ার পর এনসিপির নেতাকর্মী, সমর্থকেরা অভিযোগ করেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হতে না পেরে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফের প্রতি 'আক্রোশ' থেকে নিজের মালিকানাধীন চ্যানেলে প্রতিবেদনটি করিয়েছেন প্রয়াত রাজনীতিবিদ সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেন। তিনি এ চ্যানেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ডিএসসিসির মেয়র হতে না পেরে ইশরাক অপপ্রচারে নেমেছেন বলে অভিযোগ করেন আসিফ মাহমুদও। মঙ্গলবার দুপুরে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে এ অভিযোগ করেন তিনি। আসিফ সমর্থকদের প্রশ্ন, দেশে এতো ইস্যু থাকতে উপদেষ্টার বাবাকে নিয়ে চ্যানেলটির অনুসন্ধান কেন?

বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, ক্ষমতাবানের স্বজনদের দিকে গণমাধ্যম সবসময় বাড়তি নজর রাখে, নজরদারি করে। এটা প্রায় সারা দুনিয়ার গণমাধ্যমে স্বীকৃত চর্চা। তাছাড়া আসিফের বাবা গত এক বছরের মধ্যে একাধিকবার সংবাদের শিরোনামে এসেছেন। বাবার কর্মকাণ্ডের জন্য এর মধ্যে আসিফ মাহমুদ 'দুঃখ'ও প্রকাশ করেন। আলোচনা-সমালোচনার মুখে বাতিল করা হয় তার বাবার ঠিকাদারির নিবন্ধন। যে কোনো ক্ষমতাবান, শীর্ষ রাজনীতিবিদ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনদের দিকে গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী নজরদারি অন্যায়ের কিছু নয়। এটা বাংলাভিশন, বা যে কোনো গণমাধ্যম করতেই পারে। এখানে মূল বিবেচ্য হচ্ছে, ওই গণমাধ্যম যা লিখেছে, বা প্রচার করেছে, সেটা তথ্যভিত্তিক কী না।

বাংলাভিশনের 'ক্রাইম অ্যান্ড করাপশনের' উপস্থাপক সুজন মাহমুদ। অনুষ্ঠানটির মোট ২৩টি পর্ব তার উপস্থাপনাতেই প্রচারিত হয়। তিনি ২০১০ সাল থেকে এ চ্যানেলে সাংবাদিকতা করছেন। যোগাযোগ করলে তিনি সুখবর ডটকমকে বলেন, 'এ চ্যানেলে কোন প্রতিবদন করা হবে, কোনটা করা হবে না, এ বিষয়ে মালিকপক্ষের পরামর্শ থাকে না। সংবাদ বাছাইয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোই তা স্বাধীনভাবে করে আসছে।' তার মতে, 'পুরো প্রতিবেদন না দেখেই অনেকে আমাদের প্রতিবেদনকে প্রোপাগান্ডা বলছেন। এটা আগে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ করত। গত ১৬ বছর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে সাংবাদিকতা করেছি, কারোর তোয়াজ করে চলিনি কোনোদিন।'

প্রবাসী সাংবাদিক ও গণমাধ্যম পর্যবেক্ষক জাওয়াদ নির্ঝর এসব প্রসঙ্গে ফেসবুক পোস্টে বলেন, 'উপদেষ্টা আসিফ মনে করেন, তার বাবার বিরুদ্ধে বাংলাভিশন নিউজ করেছে। কারণ, ওই টিভির মালিকপক্ষ বিএনপির নেতা ইশরাক মেয়র হতে পারেননি বলে। এগুলো একদমই বাচ্চাকাচ্চা-সুলভ কথাবার্তা। গণমাধ্যমে নিউজ হয়েছে, সেটার অভিযোগগুলো খণ্ডানো এবং ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত ছিল উপদেষ্টা আসিফের। অভিযোগ উঠলে সেটা মিথ্যা প্রমাণ করার দায়িত্ব অভিযুক্তের, অভিযুক্ত মহলের। আর ভিডিও রিপোর্টটিতে ভিকটিমদের সরাসরি বক্তব্য আছে।'

মালয়েশিয়া প্রবাসী সাংবাদিক মুনওয়ার আলম নির্ঝর মনে করেন, 'গণমাধ্যমের মালিকানা কার, এটা দেখার আগে আলাপ হওয়া উচিত প্রতিবেদনটি নিয়ে। এ বিষয়ে প্রথমে কাজ করার কথা ছিল ফ্রিল্যান্স ফ্যাক্টচেকারদের। তারা প্রতিবেদনটি যথাযথ অনুসন্ধানী মানদণ্ড মেনে তৈরি হয়েছে কী না, ভুক্তভোগীদের বক্তব্য আছে কী না, তা দেখবেন। এরপর স্বাধীন গণমাধ্যমগুলো এটাকে ধরে ফলোআপ করবে। যদিও স্বাধীন দেশে এত বছরেও স্বাধীন গণমাধ্যম হয়নি। গণমাধ্যমের সংবাদ বিশ্লেষণ করার জন্য এমন একটা সঠিক প্রতিষ্ঠান নেই, যারা পুরো প্রতিবেদন দেখে ঠিক করবে প্রোগ্রামের ফ্রেমিং কী ছিল।'

গণমাধ্যম পর্যবেক্ষক মুনওয়ার আলম নির্ঝর বলেন, 'ব্যক্তিগতভাবে নয়, এটা বলতে হবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে। চেক করে বলতে হবে। পলিটিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টালাইজেশন অব মিডিয়া থিওরি আসলেই ব্যবহার হয়েছে, নাকি বলার জন্য বলছে। বাংলাভিশনের পুরো অনুষ্ঠান থেকে একটা বিষয় নিশ্চিত যে, অপরাধগুলো ঘটেছে। কাজেই এই অপরাধীদের খুজে বের করলেই তো পরিষ্কার হয়ে যাবে, আসল অপরাধী কে, কে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছেন আর কে নির্দোষ। এ জন্য বছরের পর বছর ধরে বলছি, স্বাধীন গণমাধ্যম দরকার। গণমাধ্যম কমিশন আর প্রেস ইনিস্টিউটের মতো লোক দেখানো নখদন্তহীন প্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসবে না।'

বাংলাভিশনের প্রতিবেদনটিকে অনেকে বলছেন, এটা একধরনেরে ফলোআপ। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ দৈনিক প্রথম আলোর এক কলামে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সাংবাদিকতার একটি বড় দুর্বলতার দিক হচ্ছে দেশের গণমাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত বিষয়ে ফলোআপ করা এবং এ বিষয়ে শ্রোতা-পাঠক-দর্শকদের ক্রমাগতভাবে অবহিত করার ব্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণে আগ্রহী নয়। কিন্তু সাংবাদিকতাকে এই সময়ে প্রাসঙ্গিক থাকতে হলে এ বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি। দেশে অনলাইন গণমাধ্যমের সঙ্গে যারা যুক্ত, এই কথাগুলো তাদের মনে রাখা দরকার।'

বিশেষজ্ঞদের মতে, আজকের দিনে ফলোআপ প্রতিবেদন প্রকাশের গুরুত্ব বেড়েছে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে সিয়াটল টাইমসের কলামিস্ট জন টালটন ২০১৮ সালে 'ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক'কে বলেছিলেন, এখন খুব দ্রুত তথ্য সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়, কিন্তু প্রায়ই এটা খোঁজার চেষ্টা হয় না এরপরে কী ঘটেছিল কিংবা এ ঘটনার শেষ হলো কীভাবে। এগুলো শুধু যে পাঠকদেরই সাহায্য করে তা নয়, ভালো রিপোর্টাররা এ থেকে আরও অনেক রিপোর্টের উপাদান পেতে পারেন। অনলাইন মিডিয়া ও টিভি চ্যানেলগুলোর অনলাইন ভার্সনের জন্য ফলোআপ মুদ্রিত মিডিয়ার চেয়ে বেশি দরকার।

আসিফ মাহমুদ উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ইশরাক হোসেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া

সুখবর এর নিউজ পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

খবরটি শেয়ার করুন